বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ফ্রি ফায়ার-পাবজির মতো গেমে আসক্তি বাড়ছে

করোনায় শিশুদের সময় অবসর কাটে স্মার্টফোন বা ট্যাবের স্ক্রিনে
করোনায় শিশুদের সময় অবসর কাটে স্মার্টফোন বা ট্যাবের স্ক্রিনে  © প্রতীকী ছবি

মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দীর্ঘ ১৫ মাস বন্ধ দেশের সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সময়টা এখন বিভিন্ন গেমের পেছনে ব্যয় করছে শিশু-কিশোররা। এর ফলে পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি তারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এসব গেম খেলতে না দেয়ায় অভিভাবকের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে গত সপ্তাতে চাঁদপুর ও বগুড়ায় দুই কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করেছে।

ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আসক্তি নতুন কিছু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে এই আসক্তিকে মানসিক রোগের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনার বন্ধে এসব গেমে ছেলেমেয়েদের আসক্তি বাড়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। তাদের দাবি, এসব গেম খেলতে নিষেধ করলে ছেলেমেয়েরা তাদের  কথা শুনছে না। 

মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এসব গেমিংয়ের আসক্তি থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে— এসব গেম বন্ধের উদ্যোগে নিতে চাইলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় রয়েছে, সবাই একযোগে কাজ করবে।

গত বছরের মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ফলে করোনায় একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে টিভি ও অনলাইনে ক্লাস চলায় অল্প বয়সে হাতে হাতে ইন্টারনেট সুবিধা মোবাইল ফোন চলে গেছে। ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা বুঁদ হয়ে আছে অনলাইন ভিডিও গেমিংয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সবচেয়ে বেশি আসক্তি বাড়িয়েছে পাবজি, ফ্রি ফায়ার, কল অফ ডিউটি, প্রো ইভুলেশন সকার (পেইস) সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও গেমস। বর্তমানে খেলার মাঠ, রাস্তার পাশে, টঙ দোকানে, নির্জন স্থানে দলবেঁধে গেমিংয়ে মত্ত শিশু-কিশোরটা।

প্রযুক্তি নির্ভর এসব অনলাইন গেমস খেলতে অনেক সময় টাকার প্রয়োজন হয়। এই অর্থ তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করে তা নিয়েও আতঙ্কিত অনেক অভিভাবক। ছোট বাচ্চারা বাবা-মার কাছে জেদ ধরে টাকা আদায় করে। এসব বিষয়ে মনোমালিন্যের জেরে আত্মহত্যার মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে।

গত ২১ মে চাঁদপুরে স্মার্টফোনে 'ফ্রি ফায়ার' গেম খেলার জন্য ইন্টারনেট কেনার টাকা না পেয়ে মামুন (১৪) নামের এক কিশোর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ২৪ মে বগুড়ায় স্মার্টফোনে ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলতে না দেওয়ায় চিরকুট লিখে উম্মে হাবিবা বর্ষা (১২) নামে এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বর্ষা চিরকুটে লেখেন, ‘বাবা-মা আমাকে ফ্রি ফায়ার গেম খেলতে দিত না। বকাঝকা করতো। তাই আমি চলে গেলাম। আমাকে আর বকাঝকা করতে হবে না’।

আরও পড়ুন: ‘ফ্রি ফায়ার’ খেলতে না দেয়ার চিরকুট লিখে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজি গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ,যাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোর। এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ফ্রি ফায়ার গেমের ৫০০ মিলিয়নের বেশি নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছে। অন্যদিকে পাবজি গেমটিরও মোবাইল ডাউনলোড প্রায় ২৩৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে একটি জরিপে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছেন। যাঁদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী। (জেওয়াউ ফ্যাম, ২০১৮)। 

ভিডিও গেমে আসক্তি ব্যাপারে স্কুল শিক্ষার্থী মো. আসিফ বলেন, আগে গেমস খেলতাম না। কিন্তু করোনায় ঘরবন্দি থেকে একঘেয়েমি দূর করতে গেম খেলা শুরু করি। এখন গেমস ছাড়া অন্যকিছু ভালো লাগে না।

মেহেদী হাসান নামে কলেজে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন ,প্রথমদিকে করোনা আতঙ্কে বাসা থেকে বের হতে দিতোনা। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধের ফলে দিনের বেশিরভাগ সময় বাসায় একঘেয়েমি চলে আসতো । তাই বন্ধুদের সাথে অনলাইনে গেমস খেলা শুরু করি এখন আর ছাড়তে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাত জেগেও গেম খেলে দুপুরে ঘুম থেকে উঠেও গেম খেলে। এর ফলে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। গেমে আসক্তির ফলে ডাকলেও অনেক সময় সাড়া দেয় না। এছাড়া অনলাইন ক্লাসের দোহাই দিয়ে গেমিং কিংবা বন্ধুদের সাথেই চ্যাট করে দিন পার করছে তারা। এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন আমি।

স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী শামীমের মা আছিয়া খানম বলেন, গেম খেলার নেশায় সন্তানরা ঘরের বাইরে বের হয় না, সারাদিন বাসায় থাকে। এদের খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নাই। করোনা আসার পর গেম খেলার মাত্রা আরো বেড়েছে। দ্রুত এসব গেমস বন্ধ করা উচিত।

আরও পড়ুন: ‘ফ্রি ফায়ার’ খেলতে এমবি কেনার টাকা না পেয়ে কিশোরের আত্মহত্যা

এ প্রসঙ্গে প্রাথমিকে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, সন্তানদের একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট থাকলেই খুশি। সারাদিন মোবাইলে গেমস,কার্টুন ইত্যাদি দেখেই সময় পার। করে। আমার বোনের মেয়ে তুবা শিশু শ্রেণিতে পড়ে তাকে মোবাইল ছাড়া ভাত খাওয়াতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা কিন্তু মোবাইল দিয়ে রাখলে দশ মিনিটেই ভাত খাওয়াতে পারছি।

মনোবিদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গেমিং ডিজঅর্ডারের সঙ্গে অতি উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা এবং তীব্র মানসিক চাপের মতো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। আসক্তির ফলে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হ্রাস, আচরণিক পরিবর্তন যেমন: মেজাজ খিটখিটে থাকা, কেউ ডাকলে সারা না দেয়াসহ বিভিন্ন নেতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ক্রমাগত এসব গেমে আসক্তির ফলে অন্যান্য কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, স্মার্টফোনের স্ক্রিনের আলোতে চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গেমিংয়ে আসক্তি বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত পরিস্থিতিই দায়ী। যেহেতু করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ফলে বাচ্চাদের আসক্তির কারণ হচ্ছে তারা প্রচুর সময় পাচ্ছে। এই সময়ে যেহেতু পারিপার্শ্বিক কাজ নাই, বাইরে যেতে পারছে না। ফলে বেশিরভাগ বাচ্চারা অনলাইন ভিডিও গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সময় ব্যয় করছে। মূলত সময়ের অপব্যবহারই আসক্তিকে বাড়াচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সাময়িক মানসিক একটা প্রশান্তি পেয়ে বাচ্চারা অনেকক্ষণ গেম খেলছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সুদুরপ্রসারি চিন্তা করলে পরবর্তীতে এটির প্রভাব আরও বেড়ে যাবে।

অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম বলেন, বাচ্চাদের এসব গেমিংয়ের আসক্তি থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটি যেন বাচ্চারা প্রযুক্তির অপব্যবহারে ব্যয় না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই অবসর সময়টুকু বাচ্চাদের বাইরের পরিবেশে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সংস্কৃতি চর্চা, বই পড়া,  স্কুলের অনলাইন ক্লাস এসব মাধ্যমে যদি উৎসাহী করা যায় তাহলে আসক্তির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমে আসবে।

ফ্রি ফায়ার-পাবজির মতো গেম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা, এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এটা শুধু এককভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় রয়েছে, সবাই একযোগে কাজ করবে। কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যসহ সকল বিষয়ে নিরাপদ রাখা, আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


সর্বশেষ সংবাদ