টাকার ইতিহাস: বিনিময় প্রথা থেকে বিটকয়েন
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৯ PM , আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৭ PM
টাকা—মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন একটি বস্তু, যার ওপর ঘুরে যায় জীবন ও বাণিজ্যের সব রীতি। হোক সেটা জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ, বা বহুদিন ধরে লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন, শেষ পর্যন্ত মানুষের যাত্রাপথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহচর হয়ে ওঠে টাকা। কয়েন, কাগুজে নোট, ক্রেডিট কার্ড বা বিটকয়েন—যে কোনো রূপে এটি উপস্থিত হোক না কেন, এর প্রভাব অনুভূত হয় প্রতিটি লেনদেন, প্রতিটি সিদ্ধান্ত এবং প্রতিটি সম্ভাবনার মধ্যে। যুগে যুগে অর্থের এই বিবর্তন শুধু ব্যবসার গতিকে বাড়ায়নি, বরং মানব সভ্যতার চেতনা, সংস্কৃতি ও সম্পর্কের দিকনির্দেশক হিসেবেও কাজ করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক টাকার ইতিহাস।
বিনিময় প্রথা থেকে শুরু
প্রায় ৫,০০০ বছর ধরে মানব ইতিহাসে টাকা কোনো না কোনো রূপ বিদ্যমান ছিল। তার আগের সময়ে মানুষ সাধারণত বার্টার বা পণ্য-সামগ্রী বিনিময় পদ্ধতি ব্যবহার করত। সে সময় গবাদি পশু পালন এবং ফসলের চাষকে কেন্দ্র করে গৃহস্থালি পশু-পাখি এবং উদ্ভিদজাত পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক তার গমের বদলে জুতো তৈরির কারিগর থেকে জুতো পেত। কিন্তু এই ধরনের বিনিময় সবসময় জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছিল।
আংশিক মুদ্রার উদ্ভাবন: কয়েক শতাব্দীর মধ্যে কিছু সহজে বাণিজ্যযোগ্য জিনিস—যেমন পশম, লবণ, অস্ত্র লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এগুলো পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর ফলে ব্যবসায়িক লেনদেনের গতি বৃদ্ধি পায়।
প্রথম মুদ্রা ছাপানোর ইতিহাস
২০২১ সালে চীনের জেংঝৌ স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদরা ঘোষণা করেন, হেনান প্রদেশের গুয়ানঝুয়াংয়ে বিশ্বের প্রাচীনতম কয়েন ছাপানোর স্থানের খোঁজ মিলেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ সালে এখানে প্রথম স্পেড কয়েন ছাপানো হয়। এটি ধাতব কয়েনের প্রথম মানক রূপ বলে ধারণা করা হয়।
প্রায় একই সময়ে, ৬০০ খ্রিস্টপূর্বে লিডিয়ার রাজা আলিয়াটস প্রথম সরকারি কয়েন, বা লিডিয়ান স্টেটার, ছাপান। কয়েনগুলো ইলেকট্রাম (স্বর্ণ ও রৌপ্যের মিশ্র ধাতু) দিয়ে তৈরি হয়েছিল এবং বিভিন্ন চিত্র দিয়ে মান নির্ধারণ করা হত। এই মুদ্রার ফলে লিডিয়ার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারিত হয় এবং এটি তখনকার সবচেয়ে ধনী সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে। আজও কেউ যখন বলে ‘ক্রেসাসের মতো ধনী’, তারা লিডিয়ার শেষ রাজা ক্রেসাসকে ইঙ্গিত করছেন, যিনি প্রথম সোনার কয়েন ছাপিয়েছিলেন।
কাগুজ নোটের উদ্ভব
চীনের ইউয়ান সাম্রাজ্য ১২৬০ সালের দিকে ধাতব কয়েন থেকে কাগুজে নোট ব্যবহার শুরু করে। মারকো পোলো, ভেনিসের একজন ব্যবসায়ী ও অভিযাত্রী, প্রায় ১২৭১ সালে চীন ভ্রমণ করার সময় দেখেন, চীনের সম্রাট কাগুজে অর্থ এবং বিভিন্ন প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম ছিলেন। চীনের নোটে তখন লেখা থাকত, ‘যারা নকল করবেন, তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে’। ইউরোপের অনেক অংশ ১৬ শতকের মধ্যে শুধুমাত্র ধাতব কয়েন ব্যবহার করত। কিন্তু ব্যাংক এবং ঋণপ্রার্থীরা ধাতব কয়েনের পরিবর্তে কাগজ নোট ব্যবহার শুরু করে। এই নোটগুলো ব্যাংকে জমা দিয়ে ধাতব কয়েনের সাথে বিনিময় করা যেত। উদাহরণ: ১৬৮৫ সালে কানাডায় (ফরাসি উপনিবেশ) সৈনিকদের জন্য খেলনার কার্ড ব্যবহার করে আইওইউ হিসেবে নোট জারি করা হয়। এটি প্রথম বৈধ কাগজ নোটের উদাহরণ।
মুদ্রা যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
কাগুজে নোট ইউরোপে ব্যবহার শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মুদ্রার মান নির্ভর করত সরকারের স্থিতিশীলতার ওপর। মুদ্রার মান কমানো বা বাড়ানোর মাধ্যমে দেশগুলো একে অপরের বাণিজ্যকে প্রভাবিত করত। এটিই প্রথম মুদ্রা যুদ্ধের উদাহরণ।
২১ শতকের ভার্চুয়াল পেমেন্ট
আজকের দিনে টাচের মাধ্যমে পেমেন্ট করা সম্ভব। এটি হলো এমন অর্থ যা পণ্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করে পরিবার, বন্ধু বা ব্যবসায়ীকে টাকা স্থানান্তর করা যায়।
ভার্চুয়াল মুদ্রা: এই ধরনের মুদ্রা শুধুমাত্র ইলেকট্রনিক রূপে বিদ্যমান। বিটকয়েন (২০০৯) এই ধরণের প্রথম সফল মুদ্রা। এটি বিনিয়োগ ও লেনদেনে ব্যবহৃত হয় এবং কেন্দ্রিয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নয়। ২০২৪ সালের আগস্টে বিশ্বের সমস্ত বিটকয়েনের মূল্য ছিল 1.14 ট্রিলিয়ন ডলার। এছাড়াও ইথেরিয়াম, এক্সআরপি, ডজকয়েনের মতো অন্যান্য ভার্চুয়াল মুদ্রাও বাজারে আছে।