ঢাবি ক্যাম্পাসে ছিনতাই: জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও
- মোতাহার হোসেন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২০ মে ২০১৯, ০২:১৫ PM , আপডেট: ২০ মে ২০১৯, ০৩:০৭ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায়ই ঘটছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এতে একটু রাত নামলেই ক্যাম্পাসে থাকা অনিরাপদ মনে করছেন অনেক শিক্ষার্থী। গত কয়েকমাসে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বিশ্লেষণ, পুলিশের তদন্ত ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব অপরাধে বহিরাগতদের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রও জড়িত।
অন্য সব হলের শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনায় জড়িত থাকলেও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, জগন্নাথ হল, স্যার এ এফ রহমান হল ও বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীরা এসব কর্মকাণ্ডে বেশি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আর তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ৩ মার্চ ঢাবি ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা ঢাকা কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সোহাগ সরকার ও তার বোন ইডেন কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মায়িদা সুলতানাকে জিম্মি করে ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এছাড়া তাদের মোবাইল ফোন ছিনতাই করে ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও স্যার এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়ের আহমেদ ও তার সহযোগীরা।
২ জানুয়ারী এসএম হলের সামনে থেকে চার কলেজ পড়ুয়া ছাত্রকে জহুরুল হক হলের মাঠে নিয়ে তাদের মারধর করে চারটি মুঠোফোন ছিনতাই করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হল ছাত্রলীগের অন্য নেতারা লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজাকে হল থেকে বের করে দেয়।
তবে আমির হামজা ছাত্রলীগ সভাপতির রাজনীতি করায় তিনি (ছাত্রলীগ সভাপতি) হামজাকে আবার হলে তোলেন এবং তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কারে ঢাবি ছাত্রলীগের করা সুপারিশ নাকচ করে দেন বলে জানা গেছে।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের শিক্ষানবিশ টেকনিশিয়ান সাইফুদ্দিন সিফাত ও ‘স্বপ্ন’ সুপারশপের বিপণনকর্মী রিয়াজুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র ও হল শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আখতারুজ্জামান (তৃতীয় বর্ষ, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ) এবং একই হলের ছাত্রলীগ কর্মী রাজিউর রহমানসহ (তৃতীয় বর্ষ, সংগীত বিভাগ) পাঁচ জনের বিরুদ্ধে এতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
২২ অক্টোবর ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ তাদের তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও একজনকে তখন পলাতক থাকে। অভিযুক্তরা হলেন- যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের মো. নাফিউর রহমান, দর্শন বিভাগের আবির হাসান, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কামরুল হাসান ও দর্শন বিভাগের মো. জর্জ।
তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং অপর জন জর্জ বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী। তিনজনকে আটকের সময় জর্জ পলাতক ছিলেন।
৩০ জানুয়ারি প্রক্টরের অফিস সংলগ্ন এলাকায় ছিনতাইকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মারুফ হোসেন সুজন ও উর্দু বিভাগের বিল্লাল হোসেনকে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে সুজন সূর্যসেন হল এবং বিল্লাল বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী।
২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকার বুয়েট হাইস্কুলের পাশে এক রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের এক নারী কর্মীর গাড়ি আটকানো হয়। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে অ্যাকাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠণিক সম্পাদক রাজিবের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী ওই নারী।
একই বছরের ২ নভেম্বর টিএসসি সংলগ্ন উদ্যানের গেইটে ছিনতাই করার সময় ফিন্যান্স বিভাগের আরিফুর রহমান নিলয় এবং আসাদ আহম্মেদকে হাতেনাতে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। তাদের মধ্যে নিলয় সূর্যসেন হল এবং আসাদ জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিনতাইয়ের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের ছাত্রলীগকর্মী এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র মাহবুব আলম, একই হলের ছাত্রলীগকর্মী ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের মাহমুদুল হাসান এবং পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের মিরাজুল ইসলামকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। পরে মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনছার আলীর বান্ধবীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে তার মুঠোফোন ও ডেবিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় একটি চক্র। পরে তারা টিএসসির এটিএম বুথ থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলে নেয়। এর আগে আনছার আলীর বান্ধবীর গলার চেইন ও কানের দুল ছিনিয়ে নেয় তারা।
সে চক্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাটিজ বিভাগের ছাত্র রাজীব বাড়ৈসহ বেশ কয়েকজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। অন্তত ১৪ জনের একটি গ্রুপ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছিনতাইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তখন পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। যাদের অধিকাংশই জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালি মন্দিরের পেছনে ছিনতাইকালে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের আরিফ, ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের মামুন ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের তানজিমকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। তাদের আটকের সময় সিহান ও রায়হান নামে দুজন পালিয়ে যায়। তাদের সবাই ফজলুল হক মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন।
এভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঘটায় বিশেষত রাতের ক্যাম্পাসকে অনিরাপদ মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থবর্ষের ছাত্র মাসুদ রানা বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের একটি চক্রও গড়ে ওঠার কথা শোনা যায়। কি কারণে তারা এ ধরণের অপরাধে জড়াচ্ছে তা খুঁজে বের করতে প্রাশসনকে আরও তৎপর ভূমিকা রাখতে হবে।’
এসব অপরাধে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম। তবে অবৈধভাবে এভাবে ছাত্রলীগকে জড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ সংগঠনের নেতাদের। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের পরিচয়টা অনেক অপরাধী তাদের অপরাদের বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকে। আমরা মনে করি অপরাধীর কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমরা একইসঙ্গে ছিনতাই ও মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর।’
তিনি আরো বলেন, ‘ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ও সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্যে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে বলেছি একটি নিরাপত্তামূলক ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সহজেই তাদের অভিযোগ তুলে ধরতে পারবে।’
নিয়মিতভাবে ক্যাম্পাসে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোন তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কার্যক্রম সংগঠিত হওয়ার এক পর্যায়ে গত বছরের জুলাইয়ে বহিরাগতদের অবস্থান ও ঘোরাফেরা নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। এছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় প্রশাসনিক চৌকি বসানোর সিদ্ধান্তের কথা জানালেও তার কোনোকিছুই দৃশ্যমান হয়নি।
কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস চারদিক থেকে খোলা। এ কারণে খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে ও অপরাধ করে দ্রুত পালিয়েও যায়। তাই তাদের সবসময় আটক করা ও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে সব সময় সোচ্চার রয়েছি। কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেই, সে যেই হোক না কেন। আমরা মাদকের ব্যাপারে কোন ছাড় দেইনা। ভবিষ্যতে আমরা এ ধারা অব্যাহত রাখবো। আমরা একটি সুন্দর ও শিক্ষাবান্ধব ক্যাম্পাস চাই।’