বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মিছিলের শেষ কোথায়

আত্মহত্যার মিছিলে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা
আত্মহত্যার মিছিলে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীরা  © টিডিসি ফটো

নানা কারণে হতাশা-বিষন্নতা অনেক বেশি জেঁকে বসছে তরুণদের মনে। ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা একটি জটিল সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এ ধরনের কথা উদ্বেগের কথা বলছে বারবার।

বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় শিক্ষার্থীদের আত্মহননের কারণে হিসেবে পড়াশোনার চাপ, বেকার সমস্যা, প্রেমঘটিত সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, অবসাদ ও বিষন্নতাই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেটে জানা গেছে, বছরের প্রথম দুই মাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ১১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৯ জনই সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাছাড়া একজন মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া এবং বাকি আরেকজন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজে স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

সর্বশেষ শুক্রবার (৪ মার্চ) রাজধানীর শাহজাদপুরের বাসা থেকে জান্নাতুল নরিন এশা (২২) নামে এক তরুণীর ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সুবাস্তু টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, এক সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের মেয়ে তিনি। আপাতত মনে হচ্ছে এটা আত্মহত্যা। তারপরও পুলিশ তদন্ত করছে।

আরও পড়ুন: এক বছরে ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশা লেখাপড়া শেষ করেছেন বলে জানিয়েছেন তার মা সানজিদা নাহার। তিনি বলেন প্লাবন ঘোষ নামে এক ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লাগত। বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) বিকালেও তার সঙ্গে ঝগড়া করে। রাতে নিজের রুমে ঘুমাতে যাওয়ার পর অনেক ডাকাডাকি করেও মেয়ের সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশীদের ডেকে এনে দরজা ভাঙা হয়। ঘরের মধ্যে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখা যায় এশাকে।

গত ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলের পাশে এস আলম কটেজের ২১২ নম্বর রুম থেকে মেরিন সায়েন্স বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র অনিক চাকমার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার গ্রামের বাড়ি রাঙামাটি জেলার সদর উপজেলায়। আত্মহত্যার আগে অনিকের টেবিলে ৬ পৃষ্ঠার নোট (চিরকুট) পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন— এমন কিছু সেখানে লেখা রয়েছে।

১২ জানুয়ারি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (আইআইইউসি) ছাত্রী জাকিয়া চৌধুরী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাবার নাম এম জোবায়ের চৌধুরী। ঘটনার দিন দিবাগত রাত ৩টায় চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার নেভি গেট কলোনি থেকে জাকিয়ার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

একইদিনে যশোরের আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের বাথরুম থেকে ওড়না পেঁচানো অবস্থায় এক বিদেশী শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার দিন হোস্টেলের পঞ্চম তলার একটি বাথরুম থেকে ওই ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২১ বছরের তরুণী সীমা ভারতের জম্বু কাশ্মীরের বথগ্রাম জেলার যাবারপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মোহাম্মাদের মেয়ে।

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রী এরশাদ শিকদারের মেয়ে

গত ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ভাটারার নতুন বাজার নুরেরচালা এলাকায় নাজমুল আলম সেজান (২১) নামের এক ছাত্র গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানায়। তিনি রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএর শিক্ষার্থী।

৪ ফেব্রুয়ারি সকালে নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্রী পল্লবী মন্ডলের। তিনি অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায়। পল্লবীর সহপাঠীদের ভাষ্য, পল্লবী চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। বিশেষ করে বিসিএসের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে সৃষ্ট সেশনজটে তিনি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং এর জেরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন পল্লবী।

আরও পড়ুন: মেডিকেল কলেজের বাথরুমে ওড়না পেঁচানো ভারতীয় শিক্ষার্থীর মরদেহ

৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১টার দিকে ফেসবুকের নিজের টাইমলাইনে ‘ক্ষমা’ লিখে একটি স্ট্যাটাস দেন প্রীতম কুমার সিংহ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থী। পরে ২টার দিকে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগের ৬৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন প্রীতম। হতাশা থেকে প্রীতম আত্মহত্যা করে থাকতে পারে বলে জানিয়েছে তার সহপাঠীরা।

১০ ফেব্রুয়ারি চিরকুট লিখে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে আত্মহত্যা করেছেন জুবায়ের ইবনে প্রজ্ঞা নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। জুবায়ের ইবনে নুর প্রজ্ঞা রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যাল ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির এলএলবি মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা উপজেলার মাওহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ কালন।

বিয়ের তিনদিন পরই ১৫ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরে সোনিয়া আক্তার (২০) নামের এক নববধূ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার দিন সকালে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৪নং ওয়ার্ডের বাঞ্চানগর গ্রামের হাওলাদার বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

সোনিয়া ওই এলাকার আবু তাহেরের মেয়ে। সে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে তার বিয়ে হয়।

হতাশাগ্রস্থ হয়ে ফেসবুকে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস লিখে ১৭ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান নামের সাবেক এক শিক্ষার্থী। তিনি বাংলা বিভাগের ২০১০-১১ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। আত্মহননকারী ইশতিয়াকের বাড়ি যশোরের আর এন রোডে। পিতা মৃত সৈয়দ আলী পাঠান ও মাতা সৈয়দা আমেনা বেগমের সন্তান তিনি। ৫ ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয় সন্তান তিনি।

১৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে নিজ বাড়িতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্নহত্যা করেছেন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আলামিন ইকবাল খান। তিনি আইন বিভাগের ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পারিবারিক অশান্তির কারণে তিনি দীর্ঘদিন হতাশা ও কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এ কষ্টের ভার নিতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আলামিন টাইঙ্গাইল জেলা দায়রা জজ আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসাবে যুক্ত ছিলেন।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে অনার্স পড়ুয়া ৩য় এবং ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি। তাদের ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়। সম্প্রতি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মহামারীতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য’ শিরোনামে একটি জরিপে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ হতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী।

জরিপে এসব আত্মহত্যার ১১টি কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে প্রেমঘটিত সম্পর্কে ব্যর্থ হওয়া, একাডেমিক চাপ, বেকারত্বের অভিশাপ, মানসিক যন্ত্রণা অন্যতম।

জরিপের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক (মনোবিজ্ঞানী) ইফরাত জাহান বলেন, দেশের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা অনেক বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। করোনা মহামারিতে এ প্রবণতা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা নিয়ে এখনই সচেতনতার উপযুক্ত সময়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence