বিদায় ২০২৫: মবে শুরু, গুলিতে শেষ

২০২৫ সালে আলোচিত কয়েকটি ঘটনার ছবি
২০২৫ সালে আলোচিত কয়েকটি ঘটনার ছবি  © টিডিসি সম্পাদিত

বিদায়ী ২০২৫ সালে বছরজুড়ে বড় আতঙ্ক ছিল মব সন্ত্রাসের তাণ্ডব ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পূর্ব পরিকল্পনা করে, ঘটনা সাজিয়ে, চুরির অপবাদ দিয়ে, চাঁদা না দেওয়ার অপরাধে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে বছর জুড়ে। কারণে-অকারণে একটি মহল উচ্ছৃঙ্খল মানুষকে দলবদ্ধ করে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। কোথাও ঘোষণা দিয়ে দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে।

পরিকল্পিত এই মব সন্ত্রাস থেকে রক্ষা পায়নি মৃত মানুষও। বছরের শেষ মাসে এসে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ময়মনসিংহে একজন হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যার পর তার মরদেহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মবের ঘটনাগুলোয় লক্ষ্যবস্তু ছিল মাজার ও খানকা শরিফ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বাউলশিল্পী, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন: নীলক্ষেতে থাকছে না অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়

‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’র জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ এবং ‘শান্তির পায়রা’ও রেহায় পায়নি এই মব থেকে। মোটিফ পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি থানা হেফাজত থেকে পালানো হত্যা মামলার আসামি ওসি শাহ আলমকেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে গণপিটুতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনার কোনো বিচারিক অগ্রগতি দেখা যায়নি।

সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকার পল্টন এলাকায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে নির্বাচনি প্রচারণায় চলন্ত রিকশায় থাকা ওসমান হাদিকে মোটরসাইকেলে করে আসা আততায়ী মাথায় গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে শরিফ ওসমান হাদিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। এরপর তৃতীয় দিনের মাথায় ১৮ ডিসেম্বর তিনি পরপারে পাড়ি জমান।

গত ২৭ ডিসেম্বর ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে শাহবাগে চলমান আন্দোলনের নেতাদের সামনে উপস্থিত হয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী বলেন, মামলার গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের সব পরিকল্পনা ও এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে। ইতিমধ্যে মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে। কিছুদিনের মধ্যে চার্জশিট দেয়া হবে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তারিক সাঈদ মামুন (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহত মামুন ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী। জানা গেছে, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন নিহত মামুন।‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তারিক সাঈদ মামুন হত্যার ঘটনায় অস্ত্র আইনে গ্রেপ্তারের পর চার আসামিকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন মো. ফারুক হোসেন ফয়সাল (৩৮), রবিন আহম্মেদ ওরফে পিয়াস (২৫), মো. রুবেল (৩৪), শামীম আহম্মেদ (২২) ও মো. ইউসুফ জীবন (৪২)। তাঁদের মধ্যে ইউসুফ আজ দায় স্বীকার করে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। 

আরও পড়ুন: স্থগিত জকসু নির্বাচন ৬ জানুয়ারিই হবে

ফরিদপুরে কবর থেকে লাশ তুলে আগুন: রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটে গত ৫ সেপ্টেম্বর। এমনকি মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। 

বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত: রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় মেয়ের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে গিয়ে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন রূপলাল (৪০) ও প্রদীপ (৩৫) নামে দুই হরিদাস সম্প্রদায়ের লোক।

পাথর দিয়ে শরীর থেঁতলে পিটিয়ে হত্যা করা হয় লাল চাঁদকে: ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ। এই ঘটনায় ভিডিওতে দেখা যাওয়া পাথর নিক্ষেপকারী ব্যক্তিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাদের খুঁজছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে হাদি ওপরে গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‍্যাব। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সুপরিকল্পিতভাবে হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা সন্দেহভাজন শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ এবং তাকে বহনকারী মোটরসাইকেলের চালক আলমগীর হোসেন সুকৌশলে পালিয়ে ভারতে চলে গেছে। গোয়েন্দাদের দাবি, গ্রেপ্তারকৃতরা তাদের পালিয়ে যেতে ঘটনার আগে-পরে নানাভাবে সহায়তা করেছে।

সিসি টিভির ক্যামেরায় দেখা ফুটেজে মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে গুলি করা ব্যক্তি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ বলে শনাক্ত করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন আলমগীর হোসেন ওরফে আলমগীর শেখ। গুলি করার ১২ ঘণ্টার মধ্যে তারা ময়মনসিংহের ধোবাউড়া-হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান বলে দাবি করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় দিপু চন্দ্র দাসকে (২৭) উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করে লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেয়। বিচার ছাড়াই প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা, মরদেহ পুড়িয়ে দেওয়া কিংবা চরমভাবে নাজেহাল করার ঘটনাগুলো প্রশ্ন তুলছে— এই রক্তক্ষয়ী সহিংসতার দায় কার? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

দিপুর বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তোলা হয়েছিল, তবে তার কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। যে পোশাক কারখানায় দিপু কাজ করতেন সেখানে সহকর্মীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে হত্যার শিকার হতে পারেন বলে জানিয়েছে পরিবার ও স্থানীয়রা। পরিবারের ভাষ্য, এটি হঠাৎ কোনো উত্তেজিত জনতার ঘটনা নয়। পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করে দিপুকে হত্যা করা হয়েছে।

ভালুকা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করার যে অভিযোগ তোলা হয়েছে এখনো পর্যন্ত আমরা তদন্তে নিশ্চিত হতে পারিনি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ  জঘন্য অপরাধের সঙ্গে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!