অক্টোবরে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ৬৪টি, বিএনপি জড়িত ৫৭টিতে
মোট আহত ৫১৩, মৃত্যু ১০ জনের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪০ AM
অক্টোবর মাসে কমপক্ষে ৬৪ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫১৩ জন। এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলের ঘটনাই ৩৭টি। তাদের অন্তর্কোন্দলের আহত হয়েছেন অন্তত ২৮৬ জন ও নিহত ৯ জন। তাছাড়াও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও অন্যান্য দলের অন্তত ২০টি সংঘর্ষ হয়েছে, যেগুলোতে আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক।
মঙ্গলবার (০৪ নভেম্বর) প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) অক্টোবর মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিলো উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, এবং আইনের শাসনের দুর্বলতা এ মাসের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অক্টোবর মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সাংবাদিকদের উপর হামলা, রাজনৈতিক সহিংসতা, শ্রমিকদের ওপর হামলা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলীয় আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক বিরোধের কারণে সংঘর্ষের মাত্রা তীব্র আকার ধারণ করেছে, যেখানে প্রাণহানি ও আহতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এতে আরও বলা হয়, মব সহিংসতা, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, বাক্ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, সভা-সমাবেশে বাধা প্রদানের মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এসময়ে চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ও হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। এছাড়া, ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাভাষী মানুষদেরকে পুশ ইন করা, এমনকি নিরীহ বাংলাদেশিকে আহত ও গ্রেফতার এবং মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির আগ্রাসী কর্মকাণ্ড সার্বভৌমত্ব ও নাগরিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে কমপক্ষে ৬৪ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫১৩ জন। আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক বিরোধ, সমাবেশ কেন্দ্রিক সহিংসতা, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখল কেন্দ্রিক অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ মাসে সহিংসতার ৬৪ টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৩৭টি ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ২৮৬ জন ও নিহত ৯ জন, ৮টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৬০ জন, ১০টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১৩৭ জন, এবং ৯টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১০ জনের মধ্যে বিএনপির ৯ জন, ও চরমপন্থি দলের ১ জন।
প্রতিবেদন বলছে, ৬৪ টি সহিংসতার ঘটনার ৫৭ টিই ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ও বিএনপির সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে। এর পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অন্তত ১৭টি ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন আহত এবং আওয়ামীলীগের ২ জন, বিএনপির ৬ ও জামায়াতের ১ জনসহ মোট ৯ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৩৫ জন গুলিবিদ্ধ এবং চল্লিশের অধিক বাড়ি-ঘর, যানবাহন, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে ও রাজনৈতিক কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরে মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্টোবর মাসে কমপক্ষে ২২১ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন, যাদের মধ্যে ৩৭ জন (৪৭%) ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ও কিশোরী। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ০৯ জন নারী ও কন্যা শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫ জনকে। ৪৮ জন নারী ও কন্যা শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তন্মধ্যে শিশু ২১ জন। এছাড়া, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৪৯ জন, আহত হয়েছেন ২০ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে, এ মাসে ১৩৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৯৯ জন শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মাসে অন্তত ৩৪ টি ঘটনায় কমপক্ষে ৪৮ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ২৫ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ১১ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৯ জন সাংবাদিক এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ২ জনকে।
গণপিটুনির তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসের তুলনায় গণপিটুনির ঘটনা কিছুটা কমলেও হতাহতের ঘটনা থেমে নেই। এ মাসে গণপিটুনির অন্তত ১৭ টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ১৯ জন।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, অক্টোবরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর কমপক্ষে ২ টি হামলার ঘটনায় অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। এ মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৪ টি হামলার ঘটনায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ( বিএসএফ ) কর্তৃক ৪ জন বাংলাদেশিকে গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত ১৫ অক্টোবর ভারতের ত্রিপুরায় স্থানীয় বাসিন্দারা তিন বাংলাদেশি নাগরিককে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে কমপক্ষে ১৩৫ জন বাংলাভাষী মানুষকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। অপরদিকে, গত ১১ অক্টোবর বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সীমান্ত পিলার ৪০ নম্বরের কাছে নো-ম্যানস ল্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত টহলরত অবস্থায় মাইন বিস্ফোরণে বিজিবি নায়েক আক্তার হোসেনের ডান পায়ের গোড়ালি সম্পূর্ণ উড়ে যায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা গুলিতে কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে ছেনুয়ারা বেগম (৩৫) নামের এক নারী গুরুতর আহত হয়েছেন। অক্টোবর মাসে, বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তের বঙ্গোপসাগরের জলসীমা থেকে ২টি ট্রলারসহ ১৮ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি।
এইচআরএসএস বলছে, অক্টোবরে সারা দেশে কারাগারে কমপক্ষে ৭ জন আসামি মারা গিয়েছেন। ৭ জনের মধ্যে ৩ জন কয়েদি ও ৪ জন হাজতি। এ মাসে ৩৫ টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১৬ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ৩৬ জন শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন।
সুপারিশ জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ও নাগরিকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এ সব বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাবে। তাই “এইচআরএসএস”র পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় ও সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে এবং দেশের সব সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।