বেপরোয়া ‘মব সন্ত্রাস’—দশ মাসে নিহত ১৭৪, আহত ৩৬৩ জন
- মো. আবদুর রহমান
- প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ১২:০৬ PM , আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫, ০৩:১২ PM
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে রাজপথে নেমে আসে লাখো মানুষ। রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে দেশে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হলেও এর পরপরই শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি। সারাদেশজুড়ে বাড়তে থাকে সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গণপিটুনির ঘটনা। ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিতে গড়ে উঠছে বিক্ষুব্ধ জনতার আদালত—‘মব জাস্টিস’, যা অনেকের ভাষায় পরিণত হয়েছে ‘মব সন্ত্রাসে’।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৭৪ জন। আহত হয়েছেন ৩৬৩ জন। বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা কেবল আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা নয়, বরং ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থার সংকটকেও স্পষ্ট করে তুলেছে। পাশাপাশি স্পষ্ট করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতাও।
সরকার একের পর এক হুঁশিয়ারি এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে সেই বিশৃঙ্খলা থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। গত ১০ মাসে মবের শিকার হয়ে ও গণপিটুনিতে সারা দেশে ১৭৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৭৮ জন এবং গত বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৬ জন মারা গেছে।
গত আগস্ট থেকে মে পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে ৮০ জন, চট্টগ্রামে ২৮, রাজশাহী ১৪, রংপুর ৬, বরিশাল ১৭, খুলনা ১৪, ময়মনসিংহ ৫, সিলেট ৫ জনকে মব তৈরি করে হত্যা করা হয়। আর এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছেন ৩৬৩ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক মবের ঘটনা ঘটলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। সরকারের বিবৃতি ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণার পরও মব চলছে। বর্তমানে তা যেন লাগামহীন হয়ে উঠেছে।
আরো পড়ুন: ১০ মাসে ছাত্রলীগের ১৬ হামলা, আক্রান্ত ১৪টি ঘটনায়
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একাধিকবার মবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। খোদ পুলিশ সদস্যরা এখনো মবের শিকার হচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে মামলা না দেওয়া, আসামি ছাড়িয়ে নেওয়া ও বেআইনি দাবিতে থানা ও পুলিশের যানবাহন ঘেরাও, হামলা করা হচ্ছে। গত ১০ মাসে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪৭৭টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৪, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭, মার্চে ৯৬, এপ্রিলে ৫২ ও মে মাসে ৬২টি। এই পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বাড়ছে।
সর্বশেষ ২২ জুন উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নুরুল হুদাকে আটক করার সময় মব সৃষ্টি করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, স্থানীয় জনতা তাকে ঘিরে রেখেছে। তার গলায় জুতা ঝুলিয়ে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। এ সময় নূরুল হুদার গলায় জুতা পরিয়ে তাকে লাঞ্ছিত করেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মোজাম্মেল হক ঢালী।
এ মবের ঘটনায় গত সোমবার (২৩ জুন) একজনকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। যদিও পুলিশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে বলে জানিয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন, উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মো. হানিফ, থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক তোহা ইসলাম মুন্না, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মোজাম্মেল হক ঢালী ও কাইয়ুম।
নূরুল হুদার ঘটনার পর এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, মব সৃষ্টির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এর আগে ২২ জুন সকালে ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন করার অভিযোগে নূরুল হুদা ছাড়াও সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে বিএনপি। মামলার কয়েক ঘণ্টা পর মব সৃষ্টি করে নূরুল হুদাকে হেনস্তা করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতাকর্মীর যুক্ত থাকায় সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন, তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে। নূরুল হুদার ঘটনায় বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিনষ্ট করে দেওয়ার জন্য যে কয়েকজন ব্যক্তি দায়ী তার মধ্যে নূরুল হুদা অন্যতম।
এদিকে ঢাকায় মব জাস্টিস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপরলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে জাপানি সংস্থা জাইকার কারিগরি সহযোগিতায় ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডিআরএসপি প্রজেক্টের অধীনে ‘সড়ক নিরাপত্তা পোস্টার ও স্লোগান প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
আরো পড়ুন: ছাত্রদলের কোন্দলে-সংঘর্ষে ১০ মাসে নিহত ৪১
নূরুল হুদার ঘটনায় গত সোমবার গাজীপুরের এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তার সঙ্গে যেটা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে নূরুল হুদার ওপর হামলা হচ্ছে। এর জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কারা জড়িত, এটা দেখা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া আইনিভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সম্প্রতি যারা মব সৃষ্টি করছে, তাদের একজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এমন আচরণ আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করি না। যদি কেউ বড় কোনো অপরাধে জড়িত থাকে, তাহলে পুলিশকে জানান। আমরা এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেবে। সবাইকে আইন মেনে চলার আহ্বান জানাই এবং পুলিশের কাজে সহায়তা করার অনুরোধ করছি।
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কেউ সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করলে আমরা তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।’
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও নিরাপত্তবিষয়ক বিশ্লেষক ড. রুশাদ ফরিদী।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা পুলিশের চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। পুলিশ তখন জনগণের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। বহু মানুষকে পুলিশ হত্যা করেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় জনগণ থানাগুলোতে হামলা চালিয়েছে। একপর্যায়ে পুলিশ প্রাণভয়ে পালিয়ে গেছে, অনেক থানা হয়ে পড়েছে জনশূন্য। গোটা দেশ তখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া, তা বাস্তবতায় রূপ দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, গত এক বছরে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসার কথা ছিল, সরকার তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে—নিরাপত্তাব্যবস্থার দায়িত্ব অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া।
ড. ফরিদী আরও বলেন, যারা মব তৈরি করছে, তারা এখন বুঝে গেছে—যদি অনেকে মিলে একত্র হয়, তাহলে পুলিশ তাদের কিছুই করতে পারবে না। এই আত্মবিশ্বাস যে গড়ে উঠেছে, সেটিই সরকারের ওপর সবচেয়ে বড় অনাস্থার প্রকাশ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে সরকার এখনো এই অনাস্থার মূলে পৌঁছে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
আরো পড়ুন: দশ মাসে ১৬ সংঘর্ষে জড়িয়েছে ছাত্রশিবির, আহত ৬৯
তিনি মনে করেন, সরকারের প্রতি এই আস্থাহীনতা যত দিন থাকবে, তত দিন নিরাপত্তা ও শাসনের প্রশ্নে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার যদি বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে না পায়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেও সতর্ক করেন এই বিশ্লেষক।