স্কুলব্যাগে রক্ত, খাতায় দাগ—মৃত্যুই হলো শেষ পাঠ

মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত
মাইলস্টোন স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত   © সংগৃহীত ও সম্পাদিত

'সকাল বেলা ভাতটা লইয়া আইলো আব্বু, গরম ভাত, আব্বু টিফিন খামু! গরম ভাত খাওয়া হলো না তোমার, আব্বুরে তোরে একটা চুম্মা দিতে পারলাম না'—হাসপাতালে বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন সন্তান হারানো এক পিতা।

রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এখন আর শুধুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এক শোকাবহ অধ্যায় এটি; যেখানে রোজকার বই-খাতার বদলে ছড়ানো-ছিটানো রক্তাক্ত স্কুলব্যাগ, পোড়া খাতার পৃষ্ঠা আর ছেঁড়া স্কুলড্রেস সাক্ষী ভয়াবহ মৃত্যু উপাখ্যানের।

সোমবার (২১ জুলাই) বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান হঠাৎ করেই মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছেন; আহত আরও দেড় শতাধিক। আহতদের অধিকাংশই জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি।

দুর্ঘটনার সময় শ্রেণিকক্ষে যেসব শিক্ষার্থী বসেছিলেন, তাদের অনেকেই হয়তো আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবেন না। রক্তাক্ত স্কুলব্যাগ, পোড়া বই-খাতা; যা অভিভাবকদের কাছে নিতান্তই অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়। তাদের কেউ কেউ সন্তানদের খোঁজে ছুটে এসেছেন, কেউ নিথর দেহটা পেয়েছেন, কেউ-বা পুড়ে যাওয়া একমুঠো ডায়েরির সন্ধান পেয়েছেন।

ঘটনার বর্ণনায় চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া ছোঁয়ার মামা বলছিলেন, ‘খালি চুল পরে আছে ওইদিকে। আমি দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেছি। আবার ফিরে ২ ঘণ্টা ছোঁয়াকে খুঁজেছি। এক ম্যাডাম নাকি ওরে (ছোঁয়া) পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।’

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে একজন অভিভাবক কান্না চেপে বললেন, ‘সকালে রুটি দিয়ে পাঠালাম, বলল ক্লাস আছে। এখন ওকে খুঁজতে হাসপাতাল থেকে মর্গে ছুটছি। মা হয়ে আমি আর কী বলতে পারি?’

বিমানটি উড্ডয়নের সময় সম্পূর্ণ ফুয়েল ট্যাঙ্কভর্তি ছিল, যা বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল এলাকাজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আহতদের অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়। আশপাশের ভবনগুলোও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নিখোঁজের তালিকায় আছে স্কুলের শীর্ষ মেধাবী, হয়তো সদ্য সাইকেল কিনে ফেরা কোনো কিশোর, শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে আঁকা কোনো শিশুশিল্পীও আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, ক্যাপশনে লেখা, ‘সন্ধান চাই’।

লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনায় অষ্টম শ্রেণীপড়ুয়া প্রেরণা বলেছিলেন, ‘প্লেনটা আমাদের চোখের সামনে ধসে পড়েছে। অনেকের হাত-পা পুড়ে গেছে, কাউকে চেনা যাচ্ছে না।’

এই শিক্ষার্থীর ভাষ্যমতে, ‘আমি দেখেছি, অধিকাংশের হাত-পা একদম পুরে গেছে। চামড়া পুরে গেছে, স্কুল-ড্রেস ছিঁড়ে গেছে। শরীর রক্তাক্ত। চেহেরা একদম পুরে গেছে; বুঝা যাচ্ছিল না কারা যাচ্ছে, কোন শিক্ষার্থী। ওইখান থেকে অনেকেই মারা গেছে নিশ্চিত। কারণ, চেয়ারে যেভাবে বসে ছিল, আমরা দেখেছি, ওইভাবেই পরে আচ্ছে এবং হাত-পা একদম কালো। ফ্রিজ ওরা, ওইটা দেখে বুঝা গেছে, ওরা আর নেই।’

তবে শুধু শিক্ষার্থী নয়, স্কুলের শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরীর দৃঢ় উপস্থিতি ও দ্রুত সিদ্ধান্তে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের পর নিজেই ঠিকঠাক বের হতে পারেননি; পুরে গেছে তার শরীরের প্রায় ৮০ ভাগ। ৪৬ বছর বয়সী মেহেরীন জাতীয় বার্ন ইউনিটের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

তবে আজকের সকালেও যেখানে শব্দে শব্দে মুখর ছিল শ্রেণিকক্ষ, দুপুরের আগেই সেখানে সুনসান নীরবতা, কান্না আর চিৎকারের বিষাদময় ধ্বনি। মৃত্যুই যেন হয়ে দাঁড়াল শেষ পাঠ! আজ স্কুলব্যাগে নেই বই, কেবলই মৃত্যুর দাগ। পড়ন্ত দুপুরটা যেন চিরন্তন এক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!