উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনা

ছুটির ঘণ্টা বাজার আগেই বাজল জীবন ঘণ্টা

দুর্ঘটনাস্থলের কয়েকটি ছবি
দুর্ঘটনাস্থলের কয়েকটি ছবি  © টিডিসি সম্পাদিত

আজকের দিনটা ছিল একদম সাধারণ, ঠিক যেমনটা হয় প্রতিদিন। উত্তরা দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন কলেজে সকালবেলা ঘণ্টা পড়ে, ছেলেমেয়েরা বই-খাতায় মুখ গুঁজে ক্লাসে বসে, স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু আজ আকাশই নেমে এলো মৃত্যুদূতের মতো, আগুনের লেলিহান শিখায়। আজ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আর কোনো ঘণ্টা বাজেনি। শুধু বাজছে মানুষের বুকের ভেতর এক অব্যক্ত আর্তনাদ, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর, এক অসমাপ্ত জীবনের। মাত্র ১০ মিনিট পর ক্লাস ছুটির ঘণ্টা বাজার কথা ছিল; কিন্তু এর আগেই বাজল জীবন শেষের ঘণ্টা, স্বপ্নের সমাপ্তির ঘণ্টা।

দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান আকাশ থেকে ছুটে এসে বিধ্বস্ত হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে। এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এরপর চারপাশে শুধু ধোঁয়া, আগুন আর মানুষের আর্তনাদ। এখন পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে মৃত্যু শতাধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে। দগ্ধ, আহত আর নিখোঁজদের খোঁজে চলছে প্রাণপণ উদ্ধারকাজ। যেই ভবনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেই ভবনের ক্লাসরুমে আজ ছিল দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। কেউ ছিল গণিত ক্লাসে, কেউ অন্য কোনো বিষয়ের ক্লাসে। কেউ হয়তো জানালার ধারে বসে স্বপ্ন আঁকছিল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার, বাবা-মার মুখে হাসি ফোটানোর। কিন্তু স্বপ্নগুলো আজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ৮ম শ্রেণির ছাত্র প্রেরণার বর্ণনা: দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে প্রেরণা জানান,  আমাদের দুপুর ১টার দিকে ছুটি হলেও সাধারণত ১০ মিনিট পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তাই, আমরা ক্লাসেই ছিলাম। কিন্তু দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে বের হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তবে বের হয়ে যাওয়ার পর একটার দিকে হুট করে আকাশে দেখি একটি প্লেনের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এরপর আমরা যে ভবনে ছিলাম, হায়দার আলী ভবনে প্লেনটি ধস করে পড়ছে। পরে জোরে একটা বিস্কোরণ; এটার মানে আমাদের চোখের সামনে অনেকগুলো লাশ যাচ্ছে। লাশ না আসলে পুরে গেছে, হাত-পা ছিঁড়ে গেছে এমন কিছু।

প্রেরণার ভাষ্যমতে, ওইখানে সেনাবাহিনীরা ছিল। তারা সবাই দৌড়ে এসেছে, সবাইকে বের করেছে। অনেকে অল্প আঘাত পেয়েছে। অনেকেই বেশি রকমের ইনজুরড। আমাদের ওইখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে, দেখতে দেবে না কিছুই। এরপর আমাদের ঢামেক, বাংলাদেশ মেডিকেল এবং কুর্মিটোলা- এই তিনটার কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু ওই তিনটাই নাকি জায়গা নিচ্ছে না। মানুষে ভরে গেছে, এই টাইপের একটা কথা বলে সবাইকে বের করে দিচ্ছে। এরপর এই হাসপাতালে আনা হয়েছে। 

বিমানটি উড্ডয়নের সময় ছিল সম্পূর্ণ ফুয়েল ট্যাঙ্কভর্তি, ফলে বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে। আশপাশের ভবনগুলোও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৬০ জনের বেশি। তাদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়।

নিখোঁজের তালিকায় আছে স্কুলের শীর্ষ মেধাবী, হয়তো সদ্য সাইকেল কিনে ফেরা কোনো কিশোর, শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে আঁকা কোনো শিশুশিল্পী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের ছবি, ফেসবুক ক্যাপশনে লেখা, ‘সন্ধান চাই’।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের মর্গে একজন অভিভাবক কান্না চেপে বললেন, ‘সকালে রুটি দিয়ে পাঠালাম, বলল ক্লাস আছে। এখন ওকে খুঁজতে হাসপাতাল থেকে মর্গে ছুটছি। মা হয়ে আমি আর কী বলতে পারি?’ উদ্ধার হওয়া চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া ছোঁয়ার মামা বলেন, ‘শুধু চুল পরে থাকতে দেখেছি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি, এক ম্যাডাম ছোঁয়াকে উদ্ধার করে বাইরে বের করে দিয়েছে। বর্তমানে সে পিজি হাসপাতালে।’

ছোঁয়ার মামার ভাষ্যমতে, ‘শুধু চুল পড়ে আছে ওই দিকে, দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেছি। পরে দুজন আর্মি আমাকে টেনে নিয়ে ভেতর থেকে বাইরে নিয়েছে। পরে আবার এসে ২ ঘণ্টা খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। পরে এক ম্যাডাম নাকি ছোঁয়াকে, ও (ছোঁয়া) ইনজুরি হয়েছে; ওরে পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পরে এক শিক্ষক ফোন করে বলে আপনার বাচ্চাকে আমরা এখানে নিয়ে আসছি। পরে ও (ছোঁয়া) বলতেছে, মামা আমি ক্যাডেট কলেজে ক্যামনে পড়মু।’

নিখোঁজ থাকা মাইলস্টোন স্কুলের বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমার খোঁজ মিলেছে। তবে জীবিত নয়, মরদেহ মিলেছে সিএমএইচে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফাতেমার বাবা সাংবাদিক লিয়ন মির। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে আর নেই। তার মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) রয়েছে।’

শুধু শিক্ষার্থী নয়, স্কুলের শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরীর দৃঢ় উপস্থিতি ও দ্রুত সিদ্ধান্তে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন অন্তত ২০ শিক্ষার্থী। যদিও শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের পর নিজেই ঠিকঠাক বের হতে পারেননি; পুড়ে গেছে তার শরীরের একটি অংশ। ৪৬ বছর বয়সী মেহেরীন এখন জাতীয় বার্ন ইউনিটের চিকিৎসাধীন।

ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। এখনো জীবনের স্পন্দন খোঁজা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে ভেসে আসছে করুণ কান্না, মা ডাকছে ছেলেকে, ভাই খুঁজছে বোনকে। আইএসপিআর জানিয়েছে, এটি রুটিন প্রশিক্ষণ চলাকালে দুর্ঘটনায় পড়ে।

জানা যায়, পশ্চিমমুখী দোতলা ভবনটির মাঝখানে মূল ফটক ও ওপরের তলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। বিমানটি সরাসরি মূল ফটকে আঘাত করে ভবনের নিচতলায় ঢুকে এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভবনের মূল ফটকের পাশে স্টাফদের কক্ষ রয়েছে। সাধারণত এখানে কলেজের কর্মীরা অবস্থান করে থাকেন। দুর্ঘটনার সময় সেখানেই কর্মচারীরা অবস্থান করছিলেন। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।

দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি, রেড ক্রিসেন্ট, উত্তরার বিভিন্ন থানার পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে ৪৮ জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। বিমানটির ধ্বংসস্তূপ এবং ভবনের ভেতরে আটকে পড়া অংশ উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিস ও সেনাসদস্যরা বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।


সর্বশেষ সংবাদ