২৭৯ কোটির খননেও ভৈরব নদের নাব্য ফেরেনি

যশোরের বুড়িভৈরব নদের নাব্য ফেরাতে ২৭৯ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবে নদীটি পরিণত হয়েছে সরু খালে
যশোরের বুড়িভৈরব নদের নাব্য ফেরাতে ২৭৯ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবে নদীটি পরিণত হয়েছে সরু খালে  © টিডিসি

যশোরের বুড়িভৈরব নদের নাব্য ফেরাতে ২৭৯ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবে নদীটি পরিণত হয়েছে একটি সরু খালে। প্রকল্প শেষের দুই বছরের মধ্যেই পলি জমে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নৌ-যোগাযোগ, সেচ ও মৎস্য—কোনো ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত সুফল পায়নি স্থানীয় মানুষ; বরং প্রশ্ন উঠেছে পরিকল্পনা, জবাবদিহি ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, ২০১৬ সালে ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’-এর কাজ শুরু হয়। পাঁচবছর মেয়াদি প্রকল্পে সেইসময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৭২ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। পরে আরো ছয় কোটি ৩১ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের ৩০ জুন।

‘ভৈরবের নাব্য বাড়িয়ে নৌ যোগাযোগের উন্নয়ন, মাথাভাঙ্গার সঙ্গে সংযোগ পুনঃস্থাপন, ভৈরব নদ ও আশেপাশের খালগুলো খনন করে নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করাই ছিল প্রকল্পটির মূললক্ষ্য। অভয়নগর, চৌগাছা ও বাঘারপাড়া উপজেলার ২২ হাজার হেক্টর এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন। এবং সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ ভৈরব নদ ও পার্শ্ববর্তী খালগুলো খননের মাধ্যমে মাছচাষের আওতায় আনাও ছিল প্রকল্পটির লক্ষ্য’- বলেন প্রকৌশলী পলাশ।

কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে তা জানার জন্য অনুসন্ধানেরও খুব একটা দরকার হয় না। যশোর শহরের দড়াটানা সেতুর ওপর দাঁড়ালে যে কারও কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। শহরের বর্জ্যে ভরপুর ভৈরবের পানি ব্যবহারের কথা কেউ কল্পনাই করতে পারে না। কৃষিকাজে সেচসুবিধা নেওয়াও দূরস্ত।

যশোর শহরতলির পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘এই গ্রামে ভৈরবের তীরে হাজার বিঘার বেশি মাঠের জমি রয়েছে। আছে একটি খালও। অথচ, এই মাঠে সেচ দিতে হয় শ্যালো মেশিন চালিয়ে। নদ খনন হয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে পানি তোলার কিংবা অপসারণের কোনো বন্দোবস্ত করা হয়নি। এতে শীত-গ্রীষ্মে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে সেচ দিতে হয়, তেমনি বর্ষাকালে পানি জমে বিঘার পর বিঘা ফসল নষ্ট হয়।’

যশোর শহরের পুরাতন কসবা এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদ বলেন, ‘ভৈরবের শহর অংশে জেলেদের মাছ ধরতে দেখেছি। নতুন করে নদ খনন হওয়ায় আবার জেলেদের দেখা মিলবে বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু গেল কয়েক বছরে কোনো জেলে কিংবা মাছ কিছুই তো দেখতে পেলাম না।’

তার ভাষ্য, নদে পানি সামান্য আছে। কিন্তু তা দূষিত, দুর্গন্ধময়। এখানে মাছ বাঁচবে কীভাবে? আর বাঁচলেও সেই মাছ খাওয়া নিরাপদ কি না, সংশয় আছে।

রহেলাপুর গ্রামের মাছচাষি আক্তার হোসেন জানান, নদের ৫০০ মিটারের মধ্যে তার চারটি পুকুর রয়েছে। পুকুরগুলোর ২০ মিটারের মধ্যে একটি খালও আছে। কিন্তু তাতে পানি আসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে, শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে পুকুর ভরতে হয়। একই অবস্থা নদের খননকৃত ৯২ কিলোমিটার অংশজুড়েই।

এদিকে, নদ খনন হলেও প্রকল্পের কৃষি ও মৎস্য খাতে ন্যূনতম নজর দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিষয়টি লিখিতভাবে তাদের অবহিত করা হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

পরিবেশ গবেষক অধ্যাপক ছোলজার রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব ছিল, খনন করে নদটি পদ্মার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার। কিন্তু সেটা না করে অপরিকল্পিতভাবে খনন কাজ শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে উজান থেকে পানি আসার পথ রুদ্ধই থেকে গেছে। এতো বড় একটি প্রকল্পে এ ধরনের অদূরদর্শিতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে বিকল্পও আছে।’

তিনি বলেন, ‘মাথাভাঙা নদীর কিছু অংশ ভারতে থাকার কথা বলে সেইসময় সংশ্লিষ্টরা গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের ক্যানেলের মতো বিকল্প পথ অনুসরণ করেনি। আমরা অসংখ্যবার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ভ্রুক্ষেপ না করে ইচ্ছেমতো কাজ করেছে। যার মাশুল গুণছেন ভৈরব নদের সাথে সম্পৃক্ত যশোরসহ আশপাশের এলাকার মানুষ।’

‘উজান থেকে পানিপ্রবাহ না থাকলে পলি অপসারণের কোনো সুযোগ থাকে না। এতে জোয়ারের সাথে উঠে আসা পলি জমতে থাকে। ভৈরব নদের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। খননের দুই বছর যেতে না যেতেই ধীরে ধীরে পলি জমে নদটি ফের আগের অবস্থানে ফিরে গেছে,’ বলছিলেন অধ্যাপক ছোলজার।

এদিকে নদ খনন করা হলেও এর ওপর নির্মিত অপ্রশস্ত সেতু, কালভার্টগুলো রয়ে গেছে অক্ষত। ফলে, পানি প্রবাহে বাধা অপসারিত হয়নি। নীতি অনুযায়ী, নদীর তটরেখার চেয়ে বেশি হতে হবে সেতুর দৈর্ঘ্য। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ (এলজিইডি) সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নদের ওপর যে সেতু-কালভার্টগুলো তৈরি করেছে, তার প্রায় সব কটিই অতি সংকীর্ণ।

যশোর শহরতলির পুরনো খয়েরতলার সঙ্গে নূরপুরের সংযোগ স্থাপন করতে তৈরি করা কালভার্টটির মতো ভয়াবহ স্থাপনা রয়েছে ভৈরবের ওপর।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলনের সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান ভিটু সুবর্ণভূমিকে বলেন, ‘পুরো প্রকল্পটিতেই পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। নদের ৯২ কিলোমিটার খননকৃত অংশে ৫৩টি ব্রিজ ও কালভার্ট আছে। যেগুলো খুবই সংকীর্ণ। প্রকল্পটি নেওয়ার আগে পরিকল্পনাবিদরা বিষয়টি একেবারেই বিবেচনায় নেননি। একটি মেগা প্রকল্প পরিকল্পনার দায়িত্বশীলরা অদূরদর্শী হলে তার বিরূপ প্রভাব শুধু প্রকল্পটির ওপরই পড়ে না, গোটা দেশ জাতি সমাজব্যবস্থা অর্থনীতি এমনকী পরিবেশও এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো ব্রিজ বা কালভার্টের কাছে বর্ষাকালেও হাঁটুজল থাকে। সেখানে যেমন খনন করা হয়নি, তেমনি জোয়ারের সঙ্গে পলি এসে আরো ভরাট হয়ে গেছে।’

জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ‘২০১৬ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এরপর নয় বছর পেরিয়ে গেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এখনো অপ্রশস্ত সেতু-কালভার্টগুলো ভেঙে পুনর্নির্মাণ করেনি। এখনো বলে, চিঠি দিচ্ছি, হয়ে যাবে...কিন্তু এই চিঠি চালাচালির ভেতরে মানুষকে অন্ধকারে রেখে পৌনে তিনশ’ কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।’

সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মী হারুন অর রশিদ বলেন, ‘পরিকল্পনার অভাব, দুর্নীতি, দখল আর দূষণ অব্যাহত থাকায় ভৈরব নদ খনন প্রকল্পের কোনো সুফল মেলেনি। এখনো নদের ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। বিজিবির স্থাপনা, কুইন্স হসপিটালসহ একাধিক হাসপাতাল ও বাড়ি উচ্ছেদের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু মামলার অজুহাতে নিশ্চুপ থেকেছে প্রশাসন।’

জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সেক্রেটারি মাহমুদুল হাসান বুলু বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী নেতারা খনন কাজে যে লুটপাট করেছেন, প্রকল্প শেষ হতে না হতেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়েছি, বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সমস্যা সমাধানের দিকে না গিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করেছে। তাদের এ লুটপাটের কারণে দুই বছর না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে পুরো প্রকল্পটি।’

পরিবেশকর্মী আশিক মাহমুদ সবুজ বলেন, ‘শুরু থেকেই নদ খননের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা নিয়ে অসন্তোষ ছিল যশোরবাসীর। সেসময় মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদও জানায়। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। এতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর মানুষ ও পরিবেশ-প্রকৃতির যে সুফল পাওয়ার কথা ছিল, তা দৃশ্যমান নয়। নদের পানি এখনো দুর্গন্ধযুক্ত; যা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।’

প্রকল্প কর্তৃপক্ষের এই কাজকে যশোরবাসীর সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে মনে করেন আশিক মাহমুদ সবুজ। বলেন, ‘নদের পাড় সংরক্ষণ ব্যবস্থা, প্রতিবেশ ব্যবস্থা, ইকো সিস্টেম ডেভলপ, সৌন্দর্যবর্ধন, মাছ-পাখি-প্রাণীর আবাসন গড়ে তোলা- এসবের কোনোকিছুই করা হয়নি। অথচ, তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের টাকা ফেরত পাঠিয়ে, কাজ সম্পন্ন দেখিয়েছে পাউবো কর্তৃপক্ষ।’

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘নদটি খননের আগে একাধিক প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। ঊর্ধ্বতনরা এসে মাঠ জরিপসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেছিলেন। সে অনুযায়ীই তারা প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন এবং তা একনেকে পাস হয়। এর সঙ্গে একাধিক দপ্তর জড়িত। আমরা কেবলমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়নের তদারকি করি। এখানে আমাদের তেমন কিছুই করার থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘দখল-দূষণ ঠেকাতে আমরা বহুবার অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু অভিযানের পরপরই প্রভাবশালীদের কারণে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।’

যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কমলেশ মজুমদার বলেন, সারা দেশেই নদ-নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ার মূল দুটি কারণ হলো, ফারাক্কা ব্যারেজ ও অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ। যে কারণে এখানকার নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ কম। অনেক স্থানে তা শুকিয়েও গেছে।

‘ভৈরব নদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবহিত করা হয়েছে। আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে প্ল্যান-২ এর আওতায় সারা দেশে একইসাথে নদনদী খনন ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন শুরু হলে ভৈরবের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে,’ আশাবাদ ব্যক্ত করেন এডিসি কমলেশ মজুমদার।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence