নতুন মৌসুমে নতুন স্বপ্ন গদখালীর ফুলচাষিদের, ৫ দিনে বিক্রির টার্গেট শতকোটি টাকা
- যশোর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩২ PM
শীতের আগমনী হাওয়ায় নতুন স্বপ্নে ভাসছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী—দেশের ‘ফুলের রাজধানী’। চার দশকের ধারাবাহিক ফুলচাষের বিপ্লবে বদলে যাওয়া এই জনপদে শুরু হয়েছে নতুন মৌসুমের ব্যস্ততা। গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গাঁদা থেকে শুরু করে নানা জাতের ফুলে এখন রঙিন এক উৎসবমুখর পরিবেশ। বাজার ধরতে চাষিদের ক্ষেতে চলছে দিন-রাত পরিচর্যা, আর ভোরে ভোরে গদখালী মোকামে ভিড় জমাচ্ছেন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। বিশেষ পাঁচটি দিবসকে সামনে রেখে এবারও চাষি ও ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য—মাত্র পাঁচ দিনে শতকোটি টাকার বেচাকেনা। ৪০০ কোটি টাকার বার্ষিক ফুলবাজার ঘিরে এখন নতুন মৌসুমে প্রত্যাশা আরও উঁচু গদখালীর ফুলচাষি-ব্যবসায়ীদের।
ঝিকরগাছা কৃষি অফিস ও ফুলচাষি-ব্যবসায়ীরা জানান, যশোরের শুধু গদখালী নয়, আশপাশের আরও কয়েকটি ইউনিয়ন এবং উপজেলাতেও গ্রামে গ্রামে ফুল চাষের বিপ্লব ঘটেছে। এই অঞ্চলে ছয় হাজারের বেশি চাষি দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করছেন। এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম ফুল চাষ শুরু করেছিলেন পানিসারা গ্রামের কৃষক শের আলী সরদার। তিনি ১৯৮২ সালে এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষ করেছিলেন। তার সফলতা দেখে পরবর্তী সময়ে ধান, পাট কিংবা প্রচলিত শস্য চাষ ছেড়ে এলাকার চাষিরা ঝুঁকে পড়েন ফুল চাষে।
চার দশকের বেশি সময় ধরে সম্প্রসারিত হওয়া ফুল চাষ গদখালীকে এনে দিয়েছে ফুলের রাজধানীর খ্যাতি। এখন এই অঞ্চলের কৃষকেরা নিত্য নতুন জাতের ফুল চাষে নজির স্থাপন করে চলেছেন। গদখালীর যেদিকেই চোখ যায়, চোখে পড়ে একটার পর একটা ফুলের বাগান। বিশেষ করে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, অর্কিড, পাতাবাহারসহ অসংখ্য বাগান। এর বাইরেও চোখে পড়ে পলি হাউস বা ফুল চাষের বিশেষ ঘর। এসব ঘরে চাষ হচ্ছে জারবার ফুলের; বাজারে যার চাহিদা এখন অনেক বেশি।
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের পাশে গদখালী বাজারে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে বসে ফুলের মোকাম। এলাকার চাষিরা তাদের ক্ষেত থেকে উৎপাদিত ফুল নিয়ে হাজির হন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। দর কষাকষির মাধ্যমে ফুল কিনে পৌঁছে দেন দেশ-দেশান্তরে। হেমন্ত থেকে শুরু করে শীতের মৌসুম এবং বসন্ত অবধি ফুলের বাজার জমজমাট থাকে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ফুলের মোকাম গদখালীতে বছরে ৪০০ কোটি টাকার বেশি ফুল হাতবদল হয়। দেশের চাহিদার সিংহভাগ ফুল সরবরাহ করেন এই এলাকার চাষিরা।
গদখালী মোকামে ফুল বিক্রি করতে আসা চাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শীতকালে ফুলের উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ে। এ বছর আমরা ফুল বিক্রির প্রস্তুতি নিয়েছি। বাজারে এখন প্রতিটি গোলাপ ফুল বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে ছয় টাকা। বর্তমানে বাজারে গোলাপ ও গাঁদা ফুলে দাম সবচেয়ে কম। বাকি সব ফুলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আশা করছি বিজয় দিবস উপলক্ষে সব ধরনের ফুলের দাম বাড়বে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে ফুলের বাজার। দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলে ফুলের বাজার চাঙা হবে।’
সোহেল রানা নামে আরেক চাষি বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় বাজার পরিস্থিতি এখনো ভালো আছে। আশা করছি কিছুদিন পর বাজারে ফুলের দাম আরও বাড়বে। এভাবে বাজার স্থিতিশীল থাকলে চাষিদের খরচ পুষিয়ে যাবে, লাভবান হতে পারব।’
অনলাইন ফুল সরবারহ উদ্যোক্তা মো. আল আমিন বলেন, বিগত বছরের মত এবারও ব্যাপক ফুল সরবরাহের প্রস্তুতি নিয়েছেন চাষিরা। বাজারে ফুলের সরবরাহ বেড়েছে। বিজয় দিবসের আগে ফুলের বাজার আরও জমজমাট হবে। গদখালী মোকামের ফুলের চাহিদা সারা দেশেই আছে। এখান থেকে ফুল কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ফুল বিক্রির ধুম পড়ে। এবারও মৌসুম জুড়ে ফুলের বাজার চাঙা হবে বলে আশাবাদী চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন পাঁচটি দিবস মহান বিজয় দিবস, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বসন্তবরণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষবরণসহ ইংরেজি নববর্ষেও ফুলের বেচাকেনা বেড়ে যায়। এই দিবসগুলো ঘিরে বাজার ধরতে ব্যস্ততা বেড়েছে ফুলচাষিদের। রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকাসহ নানা প্রজাতির ফুলচাষিরা ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। এবার বর্ষায় অনেক রজনীগন্ধা ফুলগাছ মারা গেছে। উৎপাদন কম হওয়ায় মৌসুমের শুরুতে রজনীগন্ধা ফুলের দাম সবচেয়ে বেশি। বিজয় দিবসের আগে সব ধরনের ফুলের দাম বাড়বে বলেও আশায় বুক বেঁধেছেন চাষিরা।
গদখালীর ফুলচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা শীতের মৌসুমের বিশেষ দিবসগুলো ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের জন্য চাষিরা কয়েক মাস আগে থেকেই ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এবার আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে ফুলের দামে ধস নেমেছে। বিশেষ দিবসগুলোতে ফুলের দাম বাড়বে কি না, সংশয় রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে ফুলের বাজার। তবুও আশা করছি বাজার ভালো হবে।’
ঝিকরগাছার কুলিয়া গ্রামের চাষি আরিজুল ইসলাম বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে রাজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেছি। প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি। আশা করছি আরও প্রায় তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারব। মৌসুমের শুরুতেই রজনীগন্ধা ফুলের দাম ভালো পাচ্ছি। বর্তমানে ১০-১২ টাকা পিস বিক্রি করলেও এ মৌসুমে সর্বোচ্চ ২১টাকা পিস রজনীগন্ধা বিক্রি করেছি। যা রেকর্ড দামে বিক্রি হয়েছে।’
পটুয়াপাড়া গ্রামের চাষি তৈয়ব আলী বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে গোপাল চাষে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। গোলাপ ফুলের উৎপাদন বেশি। বাজারে গোলাপের সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম কমেছে। গাঁদা ফুলের দামেও ধস নেমেছে। আশা করছি বিজয় দিবসের আগে আবার ফুলের দাম বাড়বে। এই মৌসুমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লাভবান হতে পারব।’
গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর জানান, এই অঞ্চলে ফুলের বাজার ৪০০ কোটি টাকার। শীতের শুরু থেকেই ফুলের বাজার জমতে শুরু করেছে। চাষিরা তাদের শ্রমের ফসল ফুল বাজাতে তুলতে শুরু করেছেন। ফুলের বাজারও ভালো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ভালো দাম পাবেন বলেও আশা করছেন চাষিরা। সবমিলিয়ে তাদের আশা মৌসুমের পাঁচটি দিবসকে ঘিরে তারা শতকোটি টাকার ফুল বেচাকেনা করতে পারবেন।
গদখালীর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, বাণিজ্যিক ফুলচাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রাম থেকেই। চার দশকের বেশি সময়ের এই যাত্রায় গদখালী এলাকার চাষিদের ফুলের বাজার বছরে ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গদখালী মোকামে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হয়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে গদখালীতে ফুলের পাইকারি মোকাম চালু হয়। এরপর তিনিসহ স্থানীয় চাষি-ব্যবসায়ীদের প্রচেষ্টায় এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে এই বাজারের প্রচার ও প্রসার হয়েছে। নতুন নতুন জাত ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্যদিয়ে ফুল চাষে বিপ্লব হয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরু থেকেই ফুলের বাজার ধরতে ফুল চাষিরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছেন। ফুল চাষের ক্ষেত্রে ছত্রাকসহ যে ধরনের রোগবালাইয়ের সমস্যা দেখা দেয়, তার জন্য সব সময়ই তারা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। বাজার পরিস্থিতিও ভালো। আশা করা হচ্ছে, গদখালীর চাষিরা এই মৌসুমে যথেষ্ট লাভবান হতে পারবেন।