শহীদরা কোনো বিচার ছাড়াই জান্নাতে যাবে—হাফেজ নাসিরের শেষ কথা

মো. নাসির ইসলাম
মো. নাসির ইসলাম  © সংগৃহীত

‘দাদা, শহীদি মৃত্যুই সর্বোত্তম। শহীদরা আল্লাহর নির্বাচিত বান্দা। তারা কোনো বিচার ছাড়াই জান্নাতে যাবে। তারা হলেন রহমানের মেহমান।’—এই কথাগুলো বলেছিলেন ২১ বছর বয়সী হাফেজ মো. নাসির ইসলাম শহীদ হওয়ার মাত্র ক’দিন আগে তার দাদা মো. মকসেদ আলীর সঙ্গে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম প্রাণনাথে বসে নাতির স্মৃতি রোমন্থন করেন ৭৬ বছর বয়সী মকসেদ আলী। চোখে অশ্রু, কণ্ঠে গর্ব—বলছিলেন, ‘গত রমজানে নাসির বাড়ি এসে মসজিদে তারাবির ইমামতি করে। তার সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত সবার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।’

নাসির ছিলেন গাজীপুর জেলার তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার (টঙ্গী শাখা) আলিম প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই ধর্মে গভীর আগ্রহী এই মেধাবী যুবক ছিলেন মসজিদ-মাদ্রাসা-প্রিয়, পরহেযগার ও সমাজসেবায় আগ্রহী। তার স্বপ্ন ছিল একজন চিকিৎসক হয়ে মানবতার সেবা করা এবং ইসলামের প্রকৃত শান্তির বার্তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

নাসিরের বাবা মো. আশরাফুল ইসলাম ও মা মোসাম্মৎ নাজমা আক্তারের একমাত্র সন্তান ছিল সে। তার দুই বোন আমিনা খাতুন (১৫) ও আছিয়া মনি (১২) গাজীপুরের কোনাবাড়ির মেট্রো স্কুল অ্যান্ড কলেজে যথাক্রমে নবম ও সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে।

গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার দ্য হাউজিং সোসাইটিতে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করত এই পরিবার। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে রংপুর ছেড়ে গাজীপুরে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন এবং ২০০১ সালে নাজমা আক্তারকে বিয়ে করেন। পরে ব্যবসা শুরু করলে নাসির প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় মর্নিং সান হাই স্কুলে।

কিন্তু স্কুলের পড়াশোনা ভালো না লাগায় সে মাদ্রাসায় পড়তে চায়। পরিবারের আপত্তি থাকায় এক পর্যায়ে সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। শেষমেশ তার ইচ্ছা বুঝে তাকে ভর্তি করা হয় উত্তরা তানজিমুল উম্মাহ হিফজ মাদ্রাসায়। সেখানে ২০১৯ সালে হিফজ সম্পন্ন করে কুরআনের হাফেজ হয়। এরপর গাজীপুরের তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ২০২২ সালে দাখিল পাশ করে। ২০২৪ সালে আলিম প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিল।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ ওঠে। গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে। আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এবং দলীয় বাহিনী সহিংস দমননীতি গ্রহণ করে। ২০ জুলাই, বিকেলে গাজীপুরে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সামনে আন্দোলনে অংশ নেয় নাসিরসহ শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টার দিকে পুলিশের গুলিতে নাসির বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি তার শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে নাসিরের মোবাইল থেকে একজন ফোন করে তার বাবাকে জানায়—নাসিরকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

নাসিরের বাবা বলেন, ‘আমি, আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও বড় ভাই অ্যাম্বুলেন্সে করে বিকেল ৬টায় হাসপাতালে পৌঁছাই। কিন্তু তার জীবিত মুখ আর দেখতে পাইনি।’

চিকিৎসকরা জানান, সহপাঠীরা হাসপাতালে নেওয়ার পর নাসির আরও ৩০ মিনিট বেঁচে ছিল। কিন্তু গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হয় সরকারের নিষ্ঠুর নির্দেশনায়।

আশরাফুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেকে মৃত্যুর আগে ঠিকমতো চিকিৎসাও দেওয়া হয়নি।’

লাশ বুঝে পেতেও পরিবারকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। সন্ধ্যা ৭টায় লাশ বুঝে দেওয়ার কথা থাকলেও একজন কর্মকর্তা বলেন, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দেওয়া যাবে না। রাত ১২টা ৫ মিনিটে পুলিশ এসে সুরতহাল করে এবং লাশ পাঠানো হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে।

পরদিন ভোর সাড়ে ৩টায় পরিবারের হাতে আসে শহীদ নাসিরের মরদেহ। রাত ৭টায় গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে পরদিন ২২ জুলাই ভোর ২টা ৩০ মিনিটে রংপুরের প্রাণনাথ গ্রামে পৌঁছায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। সকাল ৭টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ নাসিরকে।

নাসির শহীদ হওয়ার আগের দিনই আরেক শহীদের জানাজায় সহপাঠীদের বলেছিল, ‘এই শহীদ জান্নাতি। আমরাও যদি শহীদ হতে পারতাম! আল্লাহ আমাদের শহীদি মৃত্যু দান করুন।”

তার মা মোসাম্মৎ নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে নাসির আল্লাহর অতিথি হয়ে জান্নাতে চলে গেছে। তার বাবার মতো আমিও গর্বিত। আমার শহীদ সন্তানের জন্য সবাই দোয়া করবেন।’

সূত্র: বাসস।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence