রামপাল গুচ্ছগ্রাম: জমি অধিগ্রহণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ে পেশা বদলের হিড়িক
- বাগেরহাট প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২১ মে ২০২৫, ০৪:২৬ PM , আপডেট: ২১ মে ২০২৫, ০৫:৫৯ PM
বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার কৈগরদাসকাঠী গুচ্ছগ্রামের মানুষের জীবনে এক সময় ছিল স্থিতিশীলতা। কৃষিকাজ, নদীতে মাছ ধরা, গবাদিপশু পালন—এই কয়েকটি পেশার ওপর নির্ভর করেই চলত এ গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের জীবন। কিন্তু এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে অধিগ্রহণ ও ভূমি দখল স্থানীয় জনগণের জীবন জীবিকার উপর প্রভাব ফেলেছে। কাজের সংকট মানুষের জীবনে এনেছে চরম অস্থিরতা।
এই গ্রামের বাসিন্দা আমিনুর রহমান, আগে কৃষিকাজ ও নদীতে মাছ ধরার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার ছিল নিজের জমি, নদীতে পাওয়া যেত প্রচুর মাছ। সে সময় পরিবার নিয়ে ভালোভাবেই চলত জীবন। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্পকলকারখানার গড়ে ওঠায় নির্গত বর্জ্যে পরিবেশ ও পানি দূষিত হচ্ছে । ফলে মাছের প্রাচুর্য অনেক কমে গেছে। বাধ্য হয়ে এখন তিনি খুলনায় গিয়ে রিকশা চালান।
তিনি বলেন, ‘আগে নিজের গ্রামে কাজ করেই সংসার চলত। এখন মাছও নেই, জমিও নেই। খুলনায় রিকশা চালাই, কিন্তু আয় কিছুই থাকে না। চার মেয়ের সংসার—কোনোভাবে দিন চলে। বড় মেয়েকে অনেক কষ্টে স্কুলে রেখেছিলাম, কিন্তু শেষমেশ তাকে বিয়ে দিতে হয়েছে। এটা আমি চাইনি।’
আমিনুর রহমান বলেন, এখন তাদের জীবনে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ভর করেছে। আগে যেখানে মাছ ধরতাম, এখন সেখানে গেলে হাত শূন্য ফিরে আসি। আর এই অবস্থার জন্য শুধু জলবায়ু নয়, নদীর পানি গরম হয়ে যাওয়াও একটা বড় কারণ—যেটা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে হচ্ছে।
এই পরিবর্তনের মুখে গোটা গ্রামের মানুষের পেশা ও জীবনধারা বদলে গেছে। একই গ্রামের ইরাদ আলী জানান, আগে কৃষিজমি ছিল, নিজে চাষ করতেন। এখন জমি নেই, অধিগ্রহণে গেছে। নদীতে মাছ ধরতে হয়। কিন্তু নদীতে যখন মাছ থাকে না, তখন তাকে অন্য পেশায় যেতে হয়।
কৈগরদাসকাঠী গ্রামের আরেক বাসিন্দা মো. এরশাদ আলী গাজী বলেন, ‘আগে নদীতে বেশি মাছ পাওয়া যেত, এখন অনেক কমে গেছে। যখন রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গরম পানি নদীতে ছাড়া হয়, তখন কিছুই পাওয়া যায় না। তখন এলাকার বাইরে গিয়ে ধান কাটা, মাটি কাটা বা ছোটখাটো ব্যবসা করতে হয়।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ প্রভাবিত করছে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা, নদী ও জলাশয়ে পানি কমে যাচ্ছে, ফলে মৎস্যজীবীদের আয়ও হ্রাস পাচ্ছে। এতে মানুষ বাধ্য হয়ে এক পেশা থেকে আরেক পেশায় যাচ্ছে, কখনও অন্য জেলায় কিংবা বিভাগীয় শহরে ছুটছে জীবিকার সন্ধানে। বিশেষ করে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে প্রকৃত পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা স্থানীয় জীবিকা ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
এই পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে শিক্ষার ওপরও। কৈগরদাসকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেক্সনা খাতুন জানান, ‘এখানকার মানুষ একটানা কোনো পেশায় থাকে না। মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা পেশাও পরিবর্তন করে। অনেকেই বাইরে কাজ করতে যায় ২-৩ মাসের জন্য। সঙ্গে তাদের শিশুরাও যায়, ফলে স্কুলে তারা নিয়মিত আসতে পারে না। এতে শিশুরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বাগেরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক এস কে এ হাসিব বলেন, ‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের কয়লা পোড়ানোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঋতুর পরিবর্তন হচ্ছে ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র বদলে যাচ্ছে। আগে যারা কৃষিকাজ বা মাছ ধরতেন, এখন তারা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। এতে শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পুরো সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন যদি এই গতিতেই চলতে থাকে, তাহলে আগামীতে আরও বেশি মানুষ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। এতে কিছু পেশা একেবারেই হারিয়ে যেতে পারে এবং সমাজে এক ধরনের বিপর্যয় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’