যশোরে প্রচণ্ড গরমে মারা যাচ্ছে রেণু ও পোনা মাছ

যশোরের একটি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে
যশোরের একটি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে  © টিডিসি

যশোরে টানা এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্র ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। প্রচণ্ড গরমে কাহিল প্রাণিকুল। প্রচণ্ড গরমে যশোরের মৎস্যপল্লি-খ্যাত চাঁচড়ায় হ্যাচারিগুলোয় অক্সিজেন সংকটের কারণে রেণু ও পোনা মাছ মারা যাচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন রেণু পোনা উৎপাদনকারীরা। উদ্যোক্তাদের দাবি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গত এক সপ্তাহে তাদের কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

মৎস্যচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরে ৭-৮ দিন ধরে চলছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। অথচ রেণু উৎপাদনে পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উপযোগী। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে হ্যাচারিগুলোর পানি গরম হয়ে যাওয়ায় রেণু পোনা ও পোনা মাছ মারা যাচ্ছে। ফলে অনেকে উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। আবহাওয়ার এ প্রতিকূল অবস্থা চলতে থাকলে রেণু পোনা উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন মৎস্যচাষিরা। এ পরিস্থিতিতে জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি দেওয়া, কচুরিপানা, কলমি চাষ এবং পাড়ে কলা ও পেঁপেগাছ রোপণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

হ্যাচারি মালিকরা জানান, দেশে রেণু পোনা উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে যশোর। সাধারণত ফাল্গুন মাস থেকে শুরু হয় রেণু উৎপাদনের মৌসুম। এরপর চলে মধ্য আষাঢ? পর্যন্ত রেণু পোনা উৎপাদন ও বিপণন। আর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হচ্ছে রেণু ও চারা মাছ উৎপাদনের ভরা মৌসুম। যশোরে এক সপ্তাহ ধরে ৩৯ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বয়ে যাচ্ছে। এ তাপমাত্রায় পোনা মাছ ও রেণু উৎপাদন করা সম্ভব না।

চাঁচড়া মৎস্য পোনা চাষি ও ব্যবসায়ী শাহাজাহান হোসেন বলেন, ‘আমার দুটি পুকুর আছে। দুটি পুকুরে সাদা মাছের পোনা উৎপাদন করে থাকি। বর্তমানে তাপপ্রবাহে পোনা উৎপাদন করতে পারছি না। প্রচণ্ড গরমে পানি গরম হয়ে মাছের ডিম ও ব্রুট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন: হত্যা মামলায় চার দিনের রিমান্ডে মমতাজ

একই কথা বলেন আরেক রেণু পোনা চাষি আবির হাসান শিহাব।

জি এম আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘তাপপ্রবাহের কারণে পুকুরের তলে গ্যাস হয়ে পানি গরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে পোনা মাছ মারা যাচ্ছে। সোমবার আমার দুই কেজি পরিমাণ বাটা মাছের চারা গরমে পানিতেই মারা গেছে।’

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, রেণু-পোনা উৎপাদনে যশোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জেলায় ৩৬টি হ্যাচারিতে রেণু ও চারা মাছ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কার্প জাতীয় রেণু-পোনা উৎপাদন হয় প্রায় ৬৫ টন। জেলায় রেণু-পোনার চাহিদা ১৫ টনের একটু বেশি। উদ্বৃত্ত ৫০ টন দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এ ছাড়া তেলাপিয়া পোনা, পাঙাশ রেণু, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলসা, রুই, কাতলা, মৃগেল, বিগহেড, থাইসরপুটি, কৈ, থাই কৈ, পাঙাশ প্রভৃতি মাছের রেণু পোনা উৎপাদন হয় যশোরের মৎস্যপল্লি চাঁচড়াতে। হ্যাচারির পাশাপাশি যশোরে ২ থেকে ৩ হাজার নার্সারি রয়েছে। জেলার ২ লাখ লোক মাছ উৎপাদন, চাষ এবং এ সংশ্লিষ্ট পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

মাছচাষি আলাউদ্দিন হাসান বলেন, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে হ্যাচারিগুলোয় রেণু ও চারা পোনা দিলে তা গরমে মারা যাচ্ছে। এতে করে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন চাষিরা।

আরও পড়ুন: রাজশাহী নার্সিং কলেজে বিএসসি ও ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, আহত ১০

মাতৃ ফিশ হ্যাচারির মালিক জাহিদ গোলদার বলেন, রেণু উৎপাদন মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহে রেণু উৎপাদন একেবারে কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হ্যাচারিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। 

রুপালি ফিশ হ্যাচারির মাসুদুল মণ্ডল বলেন, ‘গরমে মাছের অক্সিজেন ফেল করছে। আমাদের যতগুলো মোটর আছে সব চালিয়েও পানি ঠাণ্ডা করা সম্ভব হচ্ছে না। এত গরমে রেণু পোনা বাঁচানো সম্ভব না। যা বাঁচবে তাতে খরচ উঠবে না।’

রেণু উৎপাদনকারী নয়ন হোসেন জানান, চলতি সপ্তাহে ১২ কেজি রেণুতে মাত্র ২০ লাখ পোনা হয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবে হয়ে থাকে ৩২ লাখ পোনা। যেভাবে গরম পড়ছে এভাবে কয়েক দিন থাকলে রেণু পোনা প্রায় সব মারা যাবে।

যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির নেতা ফিরোজ খান বলেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সহসা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মৎস্য উৎপাদনে জাতীয় বিপর্যয় দেখা দেবে।

তিনি আরও জানান, যশোরের ৩৬টি হ্যাচারিতে বছরে দেড় লাখ কেজি রেণু উৎপাদন করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন: ফাজিল পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯৩ শতাংশ

যশোর জেলা মৎস্য অফিসার সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, বর্তমানে যশোরে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ চলছে। এমতাবস্থায় পোনা চাষিদের হ্যাচারি বা ঘেরে প্রচুর পরিমাণে পানি দিতে হবে। পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে যাতে থাকে সে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে পোনা উৎপাদনে সমস্যা হবে না। একই সঙ্গে জলাশয়ে কচুরিপানা ও কলমি চাষ এবং পাড়ে কলা ও পেঁপে গাছ রোপণের পরামর্শ দেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাত হলে বা তাপমাত্রা কমে গেলে রেণু উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ