বুক রিভিউ: আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’
- মোস্তাফিজুর রহমান
- প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২০, ০৭:২৯ PM , আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:১৭ AM
বাংলাভাষায় অর্থনীতির মৌলিক বই খুঁজে বের করা এবং ঘাসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পয়সা খুঁজে বের করা একই ব্যাপার। সেখানেও আবার প্রতিটি জটিলতত্বের সহজ ও রসালো উপস্থাপন পাওয়া বেশ মুশকিল। সেক্ষেত্রে এই বই পাঠককে মুগ্ধ না করে ছাড়বে না। তাই খুব সহজেই বইটি আমার প্রিয় তালিকায় উঠে এসেছে। অর্থনীতির প্রথমিক জ্ঞানের জন্য এই বই হাতে তুলে নিলে সেই হাত গভীর জ্ঞানের দিকে না বাড়িয়ে উপায় থাকবে না।
আধুনিক অর্থনীতি গণিত নির্ভর। অর্থনৈতিক বিভিন্ন তত্ব ও আদল (মডেল) বেশিরভাগ মানুষের কাছেই দুর্বোধ্য। জটিলতর বিষয়বস্তুকে যখন রসালো কৌতুক ও গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় সকলের কাছেই সেটা সহজসাধ্য হয়ে যায়। লেখক এই কাজটি পুরো বইজুড়ে করেছেন। যারা অর্থনীতি নিয়ে জানতে আগ্রহী তাদের আগ্রহ পূর্ণমাত্রায় সফল করেছেন লেখক তার ভিন্ন স্বাদের এই বই দিয়ে। বলে রাখা ভালো যে এই বই ভিন্ন স্বাদের হলেও মূলধারার অর্থনীতির প্রতি অনুগত।
অর্থনীতি বলতে আমাদের মাথায় প্রথমেই যেটা আসে তা হলো ‘এটি খুব কাঠখোট্টা আর একঘেয়েমি একটা বিষয়’। কিন্তু এই বইটিতে লেখক এই বিষয়টাকেই রম্যরচনার মত করে উপস্থাপন করেছেন। বাস্তব জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে সহজভাবে ব্যাখ্যার লক্ষ্যে লেখক বইটিতে মোট ১৫টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। তার প্রথমটাই হচ্ছে দান-খয়রাতের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা যাকে ভদ্রসমাজে উপযোগী করতে নাম দিয়েছেন পরার্থপরতার অর্থনীতি। এই প্রবন্ধটির নামেই বইটির নামকরণ।
অর্থনীতিবিদ কার্লাইল জন্মলগ্ন থেকে অর্থনীতিকে ‘হতাশাবাদী বিজ্ঞান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সে তথ্যও বাদ দেন নি। বরং তা তুলে ধরেছেন গল্প আকারে। গল্পটা এরকম ছিল অনেকদিন আগের কথা, পূর্ব বঙ্গের কোন এক রাজা ঠিক করলেন রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে অর্থনিতীবিদদের পরামর্শ নিবেন। অর্থমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন। আলোচনার পর মন্ত্রীমহোদয় রাজদরবারে এলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন অর্থনীতিবিদরা কি বললেন?’ মন্ত্রী বললেন, ‘অর্থনীতিবিদরা দুই ভাগ হয়ে গেছেন এক ভাগ আশাবাদী আরেক ভাগ হতাশাবাদী।’ রাজা বললেন, ‘হতাশাবাদীদের কথা বাদ দেন আশাবাদীদের কথা বলেন?’ মন্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘আগামী দশ বছর রাজ্যের মানুষ ঘাস খেয়ে বাঁচবে।’ রাজা হতবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে হতাশাবাদীরা কি বললো?’ মন্ত্রী বললেন, ‘আগামী দশ বছর আমরা খাওয়ার জন্য ঘাসও পাব না।’
অর্থনিতীবিদদের নিয়ে এমন রঙচটা কৌতুক যদি কোন অর্থনীতিবিদই করেন, তবে তার সমন্ধে কেমন ধারণা করা যায়? তবে আকবর আলী খান তার পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে এরকম রসালো গল্প ফেঁদেছেন।
বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধে নিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটা তথ্য না দিলেই নয়। ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে যারা ঘুষ খায় অথচ কাজ করে না তাদের শুয়োর কা বাচ্চা বলেছেন। আমলাদের দুর্ণীতির কারণ এর কুফল এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব লেখক দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন।একটি প্রবন্ধ আছে ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের অর্থনীতি’ নামে। ‘সোনার বাংলাঃ অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে সোনায় মোড়ানো বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রচলিত গল্পের সত্য মিথ্যা নির্ণয় করেছেন। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরেঃ অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত’ প্রবন্ধে ভবিষ্যতের অর্থনীতি বর্তমানের চেয়ে উজ্বলতর হবে এমন হিসাব কষেছেন। একই সাথে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তার বর্ণনা দিয়েছেন। ‘শোষণের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধে পূঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে একে অন্যের প্রতিবিম্ভ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কাল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যার অসারতা একটা একটা করে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘অর্থনৈতিক মানুষ এবং মানুষ হিসেবে অর্থনীতিবিদ’ প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদরা নিজেরাই ‘অর্থনৈতিক মানুষ’ ধারণাটি গড়েছেন এবং নিজেরাই এর পেঁছনে দৌড়াচ্ছেন এমন মন্তব্য করেছেন।
‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ প্রবন্ধে নিঃস্বার্থ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অর্নৈতিক নিয়ম মেনে সম্পাদান করলে অধিকতর ফলপ্রসু হবে সে তত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
বইয়ের শেষে বাংলা থেকে ইংরেজী ও ইংরেজী থেকে বাংলা দুই ধরণের পরিভাষা এবং নির্ঘণ্ট তুলে ধরেছেন। প্রতিটি প্রবন্ধের শেষে রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন। যা থেকে লেখকের জ্ঞনের পরিধি সমন্ধে হালকা ধারণা পেতে পাঠকের সমস্যা হবে না। সর্বশেষ ‘অর্থনীতির দর্শনের সন্ধানে’ প্রবন্ধে পরিপূর্ণ ও নিখুঁত জ্ঞান অর্জণের জন্য অর্থনীতিবিদদের সাধনা চলমান রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়