নিম্নমানের কাগজের সাড়ে ৩ কোটি বইয়ের বোঝা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে!
- আহমেদ ইউসুফ
- প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৫, ০৮:১৫ PM , আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫, ০৭:৫৯ PM

ফের কর্ণফুলী ও অগ্রণী প্রেস। ফের অনিয়ম। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তথা এনসিটিবির বিনামূল্যের বই নিয়ে বিতর্ক যেন থামছেই না। এবার সেই দায় পড়তে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। খোঁজ-খবরে পাওয়া তথ্য, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপতে গিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর হাতেনাতে ধরা পড়ে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস ও কর্ণফুলী আর্ট প্রেস। নোয়াখালীর চৌমুহনীতে প্রাথমিকের পাঠ্যবই প্রস্তুতকালে এ ঘটনা ঘটার পর এনসিটিবি কর্মকর্তারা প্রায় ৫০ হাজার পাঠ্যবই বাতিল করে। তবে অনিয়ম যেন রয়েই গেছে।
ফের একই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রেস দুটির বিরুদ্ধে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সাড়ে ৩ কোটি বই নিম্নমানের কাগজে সরবরাহ করেছে প্রতিষ্ঠান দুটি। এ সংক্রান্ত প্রমাণ হাতে পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠান দুটির অর্থ ছাড় আটকে দিয়েছেন এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। যদিও অগ্রণী এবং কর্ণফুলী প্রেসের এই সাড়ে ৩ কোটি বই ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে চলে গেছে বলে এনসিটিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এনসিটিবির শর্তানুযায়ী ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রঙিন বইয়ে কাগজের মান ৮০ গ্রাম ওয়েটের দেয়ার কথা ছিল। শর্তানুযায়ী এসব বইয়ে কাগজের ওয়েট সর্বনিম্ন ৭৮ গ্রাম দেয়ার শর্ত ছিল। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সাদাকালো বইয়ে ৭০ গ্রাম ওয়েটের কাগজ দেয়ার শর্ত ছিল। বইয়ের উজ্জ্বলতার ক্ষেত্রে প্রাথমিকের বইয়ে ৮৫ এবং মাধ্যমিকের বইয়ে উজ্জ্বলতা ৮২ নির্ধারণ ও সব শ্রেণির বইয়ে স্ট্রেন্থ ১৬ নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। কিন্তু প্রেস দুটি তাদের বইয়ে এনসিটিবি কর্তৃক বেঁধে দেয়া এই শর্ত ভঙ্গ করে বলে জানা যায়। এমনকি বেশকিছু বইয়ের উজ্জ্বলতা ৫০ এর নিচে দেয় তারা।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান মঙ্গলবার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নিম্নমানের কাগজের বিষয়ে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, আমরা তাদের ডেকেছি। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মান ঠিক করে পুনরায় বই সরবরাহ করবে। তার আগে তাদের অর্থ ছাড় হবে না। কিন্তু আমরা তো তাদের কাজ বন্ধ করে বলতে পারি না— ‘মান ঠিক করেন’। তাই আমরা তাদের ডেকে মান নিশ্চিত করতে বলেছি। তারা সেটা করবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
এনসিটিবি চেয়ারম্যানের ভাষ্য, মানহীন কাগজে বই দেয়া এসব প্রেসের ২০ শতাংশ অর্থ থেকে যাবে। অর্থাৎ মান নিশ্চিতের আগ পর্যন্ত এই অর্থ ছাড় পাবে না। এমন আরও কয়েকটি প্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। আমরা তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। তবে তাদের বইয়ের সংখ্যা বেশি না।
নিম্নমানের কাগজের বিষয়ে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, আমরা তাদের ডেকেছি। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মান ঠিক করে পুনরায় বই সরবরাহ করবে। তার আগে তাদের অর্থ ছাড় হবে না। কিন্তু আমরা তো তাদের কাজ বন্ধ করে বলতে পারি না— ‘মান ঠিক করেন’। তাই আমরা তাদের ডেকে মান নিশ্চিত করতে বলেছি। তারা সেটা করবে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।— চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
এনসিটিবির পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের সদস্য প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেস মাধ্যমিকে ১ কোটি ২৯ লাখ এবং কর্ণফুলী আর্ট প্রেস ১ কোটি ১৮ লাখ বই ছাপার কাজ পায়। এছাড়া প্রাইমারিতে প্রেস দুটি আরও ৯৪ লাখের বেশি বই ছাপার কাজ নেয়। সবমিলিয়ে দুটি প্রেসের ছাপানো মোট বইয়ের সংখ্যা ৩ কোটি ৪১ লাখ। যদিও খোঁজে জানা গেছে, প্রেস দুটি হলেও এগুলোর মালিক একই পরিবারের দুই ভাই।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এ বছর বেশ কয়েকটি লটে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার কাজ পায় অগ্রণী এবং কর্ণফুলী আর্ট প্রেস। তবে তারা চাহিত মান অনুযায়ী বই সরবরাহ না করে নিম্নমানের কাগজে বই সরবরাহে করে। বিষয়টি নিয়ে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী জানান, আমরা কোনো নির্দিষ্ট প্রেসকে নিয়ে কথা বলতে চাই না। যারাই মান খারাপ করবে, তাদের বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
তার ভাষ্য, এ বছর আমাদের বেশকিছু প্রেসের বইয়ে নিম্নমানের কাগজে দেয়ার কারণে তাদের বই এনসিটিবি কর্তৃক কেটে দেয়াও হয়েছিল। এ তালিকায় তারাও আছেন। আমরা মানের সাথে আপস করতে চাই না।
জানা গেছে, অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের কারখানা নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে। প্রেসটির স্বত্বাধিকার মো. কাউসার-উজ-জামান। এছাড়া কর্ণফুলী আর্ট প্রেসও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার গণিপুরে অবস্থিত। এই প্রেসটির স্বত্বাধিকার হিসেবে রয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান (রবিন)। যদিও নিম্নমানের কাগজ সরবরাহের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তারা।
জানতে চাইলে কর্ণফুলী আর্ট প্রেসের স্বত্বাধিকার মোঃ হাসানুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এমন কোনো অভিযোগ আমরা জানি না। আজকেই প্রথম জানলাম। আমরা বিল সাবমিট করব, ধীরে ধীরে এগুলো হয়ত পাস হবে। আমাদের বিরুদ্ধে কিছু প্রেস মালিক লেগে আছেন, যাদের কোনো কাজ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক প্রেস আছে, যারা বই ছেপে সেখানে কর্ণফুলী কিংবা অগ্রণী প্রেসের নাম বসিয়ে দেয়। যদিও সেগুলো আমাদের বই না। এটা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
‘আমাদের বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীরা দুটি করে বই পেয়েছেন। নবম-দশমে ৪-৫টি করে বই পেয়েছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।’— আব্দুল্লাহ আল মামুন, শিক্ষক নেতা, খুলনা অঞ্চল
এদিকে এনসিটিবির পক্ষ থেকে দেশের সব অঞ্চল মিলিয়ে ৯৭ ভাগ বই চলে যাওয়ার দাবি করা হলেও বেশ কয়েকটি জায়গার এর বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ স্কুলেই ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা মাত্র দুটি করে বই পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। খুলনা অঞ্চলের শিক্ষক নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষার্থীরা দুটি করে বই পেয়েছেন। নবম-দশমে ৪-৫টি করে বই পেয়েছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।’
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার একজন অভিভাবক মো. মতিউর রহমান বলেন, বই কেমন হবে কিংবা কী মানের হবে, এসব বিষয় আমাদের দেখার কথা না। বাচ্চারা বই পায়নি, ফল হলো- তারা পরীক্ষা খারাপ করবে। এটাই আমাদের উদ্বেগের বিষয়। এর আগের বছরেও বিভিন্ন কারণে পরীক্ষা পিছিয়েছে। এবার এখনও সব বই পায়নি, তাহলে তারা পড়বে কী করে?
তবে মঙ্গলবার (১১ মার্চ) এনসিটিবি ভবনে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দাবি করেন, এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে ৯৭ শতাংশ বই চলে গিয়েছে। আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাকি সব বই শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়ে যাবেন।