ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘ভাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকের সময় বামহাত পেছনে রাখতে হবে’—হল ছাত্রলীগের ১৪ নির্দেশনা
- ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২২, ০৯:৩৫ PM , আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২২, ০১:১৩ AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সব আবাসিক হলে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বৈধ সিট দেওয়া হয়না। আবাসিক হিসেবে পরিচয় পেতে দ্বিতীয় বর্ষে কিংবা তৃতীয় বর্ষে উঠতে হয় তাদের। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারা তাদের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যোগদানের বিনিময়ে হলের গণরুমে তুলেন নবীন শিক্ষার্থীদের। এ শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন এবং কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ তা শুক্রবার নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের একটি গণরুমে সাঁটানো লিখিত নির্দেশনা নোটিশ। সিনিয়রদের কীভাবে সালাম দিতে হবে বা করমর্দন করতে হবে তাও উল্লেখ রয়েছে ওই নির্দেশনায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক বছর ধরে গেস্টরুমে ‘ম্যানার’ (আচরণ) শেখানোর নাম করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আইন-কানুন শেখানো হয় হলগুলোতে। যা প্রথমবর্ষে ভর্তি হওয়া সকল নবীন ছাত্রের জন্য বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মূলত: ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্যশীল করা হয়। সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে চলে এই গেস্টরুম। নিয়মের ভিন্নতা হলে নির্যাতন, মারধর ও এমনকি ঢালাওভাবে হল থেকে বের করে দেয়ার নজিরও রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের গেস্টরুমে হাজিরা বা দলীয় কার্যক্রমে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করলে গভীর রাতে তাকে ডেকে আনা হয় হলের গেস্টরুমে। সেখানে সেই শিক্ষার্থীর জন্য বসা হয় আদালত, করতে হয় জবাবদিহি। আর সেখানে নেতৃত্বে থাকেন ছাত্রলীগের হল শাখার নেতারা। তারা শাস্তি ঘোষণা করে কার্যকরও করেন। কৃত অপরাধের শাস্তি হিসাবে গভীর রাতে তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ সময় মারধরও করা হয়। হল প্রশাসনের নাকের ডগাতেই এটা করা হয়।
নবীন শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে মুখে মুখে নানা নির্দেশনা এবং আচরণ শেখায় তাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র বর্ষের শিক্ষার্থীরা (দ্বিতীয় বর্ষ) যারা ছাত্রলীগের নেতা বা কর্মী। সব হলের গেস্টরুমে এসব শেখানো হয়। এদিকে মুখে বলার পাশাপাশি বিগত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের গণরুমগুলোর ভেতরের দেয়ালে ও দরজায় এসব নিয়ম-কানুন নোটিশ আকারে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। শুক্রবার ওই হলের এক শিক্ষার্থীকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও জঙ্গি সন্দেহে’ থানায় দেয়া দেওয়ার পর ছাত্রলীগের এসব নিয়ম-কানুনের নোটিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। (অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে পরে ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীসহ অনেকেই এসব নিয়ন্ত্রণমূলক এবং অকর্ষিত আচরণের কঠোর সমালোচনা করছেন।
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করা শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে ওই হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, আগে এই নিয়মগুলো মুখে বলে দিত গেস্টরুমে। এর পাশাপাশি ২০১৮ সাল থেকে হলের গণরুমগুলোতে এমন নোটিশ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। নিচতলা ও দোতলার গণরুমে এমন নোটিশ গতকাল বিকেল পর্যন্ত ছিল।
রাতে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা এসব নিয়ম-কানুন গেস্টরুমে নবীন শিক্ষার্থীদের শেখায়। তাছাড়া গণরুমগুলোতে এসব নিয়ম-কানুন লিখিত আকারে রাখা হয়েছে। এই নিয়মগুলো অনেক শিক্ষার্থীকে দাঁড়িয়ে মুখস্থ বলতে হয় সিনিয়রদের সামনে। ঘটনাটি আজ দুপুরের পর জানাজানি হলে বিকেলের দিকে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশে এসব নোটিশ ছিঁড়ে ফেলা হয়।
জানা গেছে, ওই হলের ১০৯ ও ২২৮ নম্বর রুম দুটি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুম। যা হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গ্রুপ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাছাড়া ১১০ ও ১১১ নম্বর রুম দুটি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুম। যা হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আরও পড়ুন: ঢাবির হল চলে ছাত্রলীগের 'সংবিধানে'
নোটিশে যেসব নিয়মকানুন রয়েছে:
ওই নোটিশে বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকতে হলে ১৪টি নিয়ম মানতে হবে। আদেশক্রমে হল ছাত্রলীগ (২য় বর্ষ)। অর্থাৎ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ আদেশ (প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের) দিয়েছেন। এসব নিয়মগুলো হচ্ছে-
১। হলের ভিতরে ও বাইরে ফার্স্ট ইয়ার ব্যতিত সকল বড় ভাইদের সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে, হ্যান্ডশেক করার সময় বাম হাত পিছনে রাখতে হবে। হাতে ঝাকি বা চাপ দেওয়া যাবে না। হাত বুকে রাখা যাবে না।
২। মসজিদ, টিভি রুম, রিডিং রুম, বাথরুম, ক্যান্টিন, ওয়াইফাই জোন, মেস এবং সেলুনে সালাম দেওয়া যাবে না।
৩। একসাথে অনেক বড় ভাই থাকলে চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সালাম দিতে হবে।
৪। প্রত্যেক বড় ভাই এবং ইয়ারমেটের ফোন নাম্বার রাখতে হবে।
৫। ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে। সমস্যা থাকলে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের বলতে হবে।
৬। গেস্টরুমে লুঙ্গি, ট্রাউজার, টি-শার্ট ও মোবাইল প্যান্ট পরে আসা যাবে না। এমনকি রাত ১২ টার আগে এগুলো পরে রুমের বাহিরে যাওয়া যাবে না।
৭। ক্যান্টিনে প্রথম চারটি টেবিলে বসা যাবে না এবং ক্যান্টিন বয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করা
যাবে না।
৮। টিভি রুমের প্রথম সারির চেয়ারগুলোতে বসা যাবে না, রিমোট হাতে নেওয়া যাবে না।
১। চেইন অব কমান্ড মানতে হবে। বড় ভাইদের অনুমতি ব্যতিত কোন রুমে যাওয়া যাবে না।
১০। বড় রিডিং রুম ব্যবহার করতে হবে, কোন ভাবেই হল সংসদ রুমে প্রবেশ করা যাবে না।
১১। হলে সিগারেট খাওয়া যাবে না, রুমে খাওয়ার পরিবেশ থাকলে খাওয়া যাবে।
১২। হলে থেকে ছাত্রলীগ ব্যতিত অন্য কোন সংগঠন যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
১৩। ছাত্রলীগ ব্যতিত অন্য কোন সংগঠনের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৪। সর্বোপরি হলের যে কোন ব্যাপারে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
ছাত্রলীগের এসব নিয়মকানুনের বিষয়ে জানতে চাইলে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আজহারুল ইসলাম মামুন বলেন, এই ধরণের কোন নিয়ম-কানুন রয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে হলে সিনিয়র-জুনিয়রদের সঙ্গে মেলবন্ধন, একাডেমিক প্রয়োজন কিংবা কোন বিপদ-আপদের প্রয়োজনে আমরা প্রায় বসি।
গেস্টরুমে বসা হয় কিনা, এ প্রশ্নটি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, হলে সিনিয়র-জুনিয়রা ৩-৪ দিন বসি। তবে ফেসবুকে যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সেটি সর্ম্পকে তিনি অবগত নন বলে জানান।
হলের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হোসেন শান্ত জানান, ফেসবুকে যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, সেটি তার নজরে এসেছে। তবে সেটি পুরোটাই ভুয়া বলে দাবি করে তিনি বলেন, কয়েকদিন যাবত কিছু লোক ষড়যন্ত্র করছে হল ছাত্রলীগ নিয়ে। এই নোটিশটি এরই একটি উদাহরণ। এই ধরণের নোটিশ কেউ দিতে পারেন কিনা, প্রশ্নও এই ছাত্রলীগ নেতার।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, এ ধরণের নিয়ম-কানুন বা নিয়ম-কানুনের নোটিশের বিষয়ে আমি অবগতত নয়। এই প্রথম আপনার (প্রতিবেদক) কাছ থেকে শুনলাম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমারতো ফেসবুকে একাউন্ট নেই, তাই বিষয়টি চোখে পড়েনি।