জাবির সাবেক ভিসি
মেয়াদ শেষ করাই একমাত্র সফলতা, হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ
- মেহেদী মামুন
- প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২২, ১১:০৮ AM , আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২২, ১১:০৮ AM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ( জাবি) ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি সপ্তাহে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি টানা দুই দফায় ভিসির দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তী ভিসি নিয়োগের আগ পর্যন্ত রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আলম।
এদিকে আন্দোলনের মুখে পরপর দুই ভিসির পতনের পর অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের পুরো মেয়াদে দায়িত্ব পালন করাকে সফলতা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া মেয়াদের পুরো সময়ই নানা ঘটনার জন্য আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন তিনি। মেয়াদের শেষ দিনও তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান শিক্ষার্থীরা।
২০১৪ সালের ২ মার্চ ভিসি হিসেবে নিয়োগ ড. ফারজানা ইসলাম। দেশের প্রথম নারী ভিসি হিসেবে শুরুতেই তিনি প্রশংসা কুঁড়ান। অস্থির ক্যাম্পাসকে স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিয়ে প্রাথমিকভাবে সফলও হন। পরে দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের অভিযোগে সমালোচিত হন।
অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজে দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ৷ অবশ্য তার আনা পাল্টা চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে শোভন-রাব্বানীকে সরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি নিজের পক্ষে রাখতে শাখা ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা ঈদ সালামিও দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠে।
আরও পড়ুন- জাবি ভিসি পদত্যাগে আল্টিমেটাম আন্দোলনকারীদের
আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে জাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর তিনি এলপিআর এ চলে গেলে অনিশ্চয়তায় পড়ে জাকসু নির্বাচন।
২০১৯ সালে ভিসি বিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অভিযোগ ওঠে আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়দের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি হয়রানির। ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের আমলেই সবচেয়ে বেশি ভারপ্রাপ্ত দ্বারা পরিচালিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে প্রক্টর, প্রধান প্রকৌশলী, কম্পট্রোলার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং জনসংযোগ অফিসের মত গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ অফিস চলেছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। এছাড়া ‘৭৩ এর অধ্যাদেশের ২৫(৫) ধারা অনুযায়ী ডিনের মেয়াদ দুই বছর। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন অনুষ্ঠিত হয়নি কোন ডিন নির্বাচন।
আরও পড়ুন- শেষ সময়ে নিয়োগে তাড়াহুড়ো জাবি ভিসির
করোনা মহামারীর অযুহাতে দীর্ঘ ৬৪০ দিন সশরীরে দাপ্তরিক কাজে অনুপস্থিত ছিলেন জাবির সাবেক ভিসি। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজে নেমে এসেছিলো কচ্ছপ গতি। সরাসরি অফিসে না আসায় একটা ফাইল স্বাক্ষর করতে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
দুই মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। মেয়াদের শেষ বছরের শুরুতেই অন্তত ৪৭টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ জন শিক্ষক এবং ১০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। অভিযোগ রয়েছে নিজ মতাদর্শের লোক নিয়োগ দিয়ে দল ভারী করছেন তিনি।
২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি করোনার সময়ে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে জাবি সংলগ্ন গেরুয়ায় এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এতে ৪০ জনের মতো শিক্ষার্থী আহত হন। শিক্ষার্থীদের দাবি সংঘর্ষ চলাকালীন তারা হলগুলোতে আশ্রয় নিয়ে চাইলে প্রশাসন কোনো ধরনের সাহায্য করেননি। ঘটনার বিচার ও তদন্তের আশ্বাস প্রশাসন দিলেও তা আজও বাস্তবায়ন করা হয় নি।
জাবিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ভর্তি ফরম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয় হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। তার মধ্যে পরীক্ষা আয়োজন প্রক্রিয়ায় ১০ কোটির বেশি ব্যয় হয়। আর দুই কোটি টাকা ব্যয় হয় অন্যান্য খাতে। বাকি আট কোটি এক লাখ ২২ হাজার টাকা শিক্ষক ও ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাগবাটোয়ারা করে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে তদন্তে নেমেছে ইউজিসি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে চরম মাত্রায় জোর দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন সিনেটের রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, প্রথম নারী ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের যে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিলো তাতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কল্যাণের বিপরীতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতের দিকে বেশি মনোযোগ দেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক পর্ষদগুলো পরিপূর্ণ করেননি এবং অংশগ্রহণমূলক সিনেট প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখাননি।
তিন বছরে ভিসি মাত্র সিনেটের একটা অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণয়ন ও পাশের ক্ষেত্রে সিনেট সদস্যদের অনুমোদনের সাংবিধানিক বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ একাধিক সিনেট সদস্যের।
আরও পড়ুন- ৬৪০ দিন পর জনসম্মুখে জাবি ভিসি (ভিডিও)
২০১৭ সালের ২৬ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সিঅ্যান্ডবি এলাকায় বাসের ধাক্কায় জাবির দুই শিক্ষার্থী নিহত হলে এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরতদের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে ৪২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে পরিস্থিতি শান্ত করতে ওই দিন রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে শাখা ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা দেয়ার অভিযোগ উঠে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ভিসির বাসভবন অবরোধ করে রাখেন। এর জেরে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে ভিসিকে বের করে নিয়ে আসেন। এ ঘটনাকে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে আখ্যা দেন এবং শাখা ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানান। ভিসির দুর্নীতির ঘটনায় হাইকোর্টে রিট করা হলেও দুই বছরের বেশি সময়েও কোনো ফলাফল জানা যায়নি।
নিয়মিত সমাবর্তনের আয়োজন করার কথা থাকলেও গত ৫০ বছরে জাবিতে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ৫ টি। ২০১৫ সালে সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত তিনবার ষষ্ঠ সমাবর্তনের আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি।
এদিকে সাবেক ভিসির বিরুদ্ধে আনীত আর্থিক দুর্নীতি ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগের সুরাহা না হওয়ায় তার বাসভবনের সামনে কাঁঠাল মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। কাঁঠাল নিয়ে মিছিলের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা মনে করিয়ে দেন, ২০১৭ সালে ক্যাম্পাসের একটি ঘটনা। সেই বছর ক্যাম্পাসে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ৬৪ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেন অধ্যাপক ফারজানা। তিনি অভিযোগ করেন- শিক্ষার্থীরা তার বাসভবনে কাঁঠাল ছুড়েছিল। ২ মার্চ বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এই কাঁঠাল মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ভিসির পক্ষের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।