চট্টগ্রাম বিভাগের করোনার জিন নকশা উন্মোচন চবি গবেষকদের

গবেষকদলে নেতৃত্ব দেয়া চবি শিক্ষকরা
গবেষকদলে নেতৃত্ব দেয়া চবি শিক্ষকরা  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাসের জিনের বিন্যাস উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলা থেকে করোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) নমুনা সংগ্রহ করে প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলার করোনাভাইরাসের জিনের বিন্যাস উন্মোচনের কাজ সম্পন্ন করেছে তারা।

পুরো গবেষণা কাজটি চবির কেন্দ্রীয় জীব বিজ্ঞান অনুষদ ও বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ল্যাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে আজ শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

পুরো গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন চবির বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইমরানুল হক ও ড. এইচ. এম. আবদুল্লাহ আল মাসুদ। এছাড়াও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মোঃ খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, মোঃ আরিফ হোসাইন ও সজীব রুদ্র, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী শান্তা পাল এবং বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ছাত্র মোঃ ওমর ফারুক সম্পৃক্ত ছিল।

গবেষকরা জানায়, ‘আমাদের একটি উদ্দেশ্য ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো কাজটি চবিতে সম্পন্ন করা এবং এটি সম্পন্ন করার জন্য সকল ধরনের লজিস্টিকস, টেকনিক্যাল সাপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ যেমন অত্যাবশ্যক ছিল তেমনিভাবে প্রয়োজনীয় রিএজেন্ট, কেমিক্যাল এবং বিভিন্ন ধরনের কিটস এর সরবরাহ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর এই বিষয়গুলোর উপর যথাযথভাবে নজর দিতে গিয়ে আমাদের কাজটি শেষ করতে প্রচুর সময় লেগেছে, যদিও প্রাথমিক ভাবে আমরা কাজটি শুরু করেছিলাম গত জুলাই মাসে এবং যা আগস্টের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল।’

গবেষকরা আরও জানায়, এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কভিড-১৯ (করোনাভাইরাস ডিজিস-১৯) এর উপর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা, সে লক্ষ্যে আমরা প্রত্যেকটি (১১টি) জেলার প্রত্যেক উপজেলা/থানা থেকে কভিড পজিটিভ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছি। তারপর, আরএনএ এর পরিমাণ (কনসেনট্রেশন) ও গুণের (কোয়ালিটি) উপর ভিওি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েনসিং এর জন্য নির্বাচন করি। যার মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯% এর উপরে উন্মোচিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২টি নমুনার জিনের বিন্যাস গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (GISAID) ডাটা বেইসে জমা দেওয়া হয়েছে (Accession no- EPI_ISL_735490, EPI_ISL_735492, EPI_ISL_735493, EPI_ISL_735494,‌ EPI_ISL_735495, EPI_ISL_735496, EPI_ISL_735497, EPI_ISL_735498, EPI_ISL_735499, EPI_ISL_735500, EPI_ISL_735501 and EPI_ISL_735502).

তাদের মতে, ‘কিছু প্রশ্নকে সামনে রেখে আমাদের এই গবেষণা কাজ সাজানো হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো চট্টগ্রামে ভাইরাসটি সম্ভাব্য কোন পথে প্রবেশ করে থাকতে পারে এবং এর মিউটেশন সম্পর্কে জানা। প্রাথমিকভাবে ৩০টি জিনোম বিন্যাস (সিকোয়েন্স) বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে (ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন–NCBI, USA), আমরা ধারণা পাচ্ছি যে, চট্টগ্রাম বিভাগের ভাইরাসটির সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সৌদি আরব, তাইওয়ান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ভাইরাসের দারুন সাদৃশ্য রয়েছে। প্রত্যেক জেলার ডাটা পৃথকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। যেমন চট্টগ্রাম জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইটালি, চেক রিপাবলিক, সৌদিআরব ও তাইওয়ান; নোয়াখালী, লক্ষীপুর ও ফেনী জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান; কুমিল্লা ও চাঁদপুরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, ভারত ও জাপান; ব্রাক্ষণবাড়ীয়াতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সৌদিআরব ও ভারত; কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানে যুক্তরাষ্ট্র, সিয়েরা লিওন, জার্মানি, ইটালি, তাইওয়ান ও চেক রিপাবলিক এবং খাগড়াছড়িতে অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও তাইওয়ান এর নমুনার সাথে সাদৃশ্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে।’  

তাদের গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, সব সিকোয়েন্সের (বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাকৃত ৩০টির) বিভিন্ন লোকেশনে সর্বমোট ১২৬টি ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন হয়েছে, যেমনঃ ORF1a জিনে ৪৬টি, ORF1b এ ২৮টি, ORF3a এ ১৪টি, ORF6 এ ১টি, ORF7a এ ১টি, ORF8 এ ৫টি, ORF9b এ ১টি, ORF10 এ ১টি, S এ ১৭টি, E এ ১টি, M এ ১টি এবং N এ ১০টি । এছাড়াও বিভিন্ন জিনের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় মোট ৮৬টি নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হলেও অ্যামিনো এসিডে কোন পরিবর্তন হয়নি। সবগুলো মিউটেশন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৫টি মিউটেশন চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। পরিবর্তনগুলো হলঃ ORF1a এ I1300F, S এ D614G, ORF1b এ P314L, N এ R203K ও G204R। উল্লেখ্য, স্পাইক প্রোটিনের (S) D614G (যা সম্প্রতি মানবদেহের প্রাইমারি কোষ/প্রাণীদেহে সংক্রমণ ও ট্রান্সমিশনকে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম বলে বিশ্ববিখ্যাত “সাইন্স” সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে; সুত্রঃ DOI: 10.1126/science.abe8499) মিউটেশনটি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত (সিভাসু/বিজেআরআই) ৭টি সিকোয়েন্সের মধ্যে ২টি (২৮.৫৭%) তে উপস্থিত থাকলেও আমাদের সম্প্রতি করা ৩০টি’তেই (১০০%) উপস্থিত আছে। যেহেতু বেশীভাগ ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিন টিকা আবিষ্কারের মুল টার্গেট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, সেহেতু আমরা এই প্রোটিনটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ভাইরাসের সিকোয়েন্স গুলোর (বিশ্লেষণকৃত ৩০টির) স্পাইক প্রোটিনের বিন্যাসে অন্য মিউটেশনের সাথে ৫টি এমন মিউটেশন পাওয়া গেছে যেগুলো GISAID ডাটাবেইস অনুসারে অন্যান্য দেশে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম শনাক্ত করা হয়। মিউটেশন গুলো হলোঃ S155I (১টি নমুনায় প্রাপ্ত), N354S (১টি), S477N (১টি), P681H (১টি), এবং V1122L (১টি)। এদের মধ্যে P681H মিউটেশন গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ভাইরাসে কয়েকটি মিউটেশনের একটি (সূত্র-https://edition.cnn.com/2020/12/24/opinions/coronavirus-variant-what-weve-learned-haseltine/index.html).

উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন  করোনাভাইরাস স্ট্রেইনে যে পরিবর্তনগুলো (১৭টি) পাওয়া গেছে তার মধ্যে স্পাইক প্রোটিনে ৬টি) N501Y, A570D, P681H, T716I, S982A, D1118H) অ্যামিনো এসিডের পরিবর্তন ও ২টি স্থানে ডিলিশন পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের মতামত ও প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, প্রাপ্ত পরিবর্তন গুলোর মধ্যে N501Y পরিবর্তনটি ACE2 রেসিপ্টরের প্রতি বন্ধনের আসক্তিকে বাড়িয়ে দিতে পারে, অন্যদিকে P681H পরিবর্তনটি স্পাইকের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে অবস্থিত যা প্রাণী দেহের রেস্পিরেটরি এপিথেলিয়াল কোষে ভাইরাসের প্রবেশ ও ট্রান্সমিশনকে বাড়িয়ে দেতে সক্ষম (সূত্রঃ https://virological.org/t/preliminary-genomic-characterisation-of-an-emergent-sars-cov-2-lineage-in-the-uk-defined-by-a-novel-set-of-spike-mutations/563). কিন্তু প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, স্পাইক প্রোটিনে উপর্যুক্ত পরিবর্তনগুলো একত্রে পাওয়া না গেলেও কয়েকটি পরিবর্তন আলাদা আলাদা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ভাইরাসটি কি একত্রে কিংবা আলাদা আলাদা পরিবর্তনগুলোর জন্য অধিক শক্তিশালী হচ্ছে কিংবা শক্তি হারাচ্ছে তা বলার জন্য আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন (সূত্রঃ https://blogs.sciencemag.org/pipeline/archives/2020/12/22/the-new-mutations). তাছাড়া, নাইজেরিয়াতে প্রাপ্ত P681H ভেরিয়েন্ট যে ট্রান্সমিশনকে বাড়িয়ে দিতে পারে এমন কোন তথ্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি (সূত্রঃ https://www.dailymail.co.uk/news/article-9085543/ANOTHER-mutant-form-coronavirus-discovered-Nigeria.html).

গবেষকরা আশা করছে,  তাদের উন্মোচনকৃত জিনের বিন্যাস চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলায় ভাইরাসের প্রকৃতি, বিস্তার, উৎপত্তিস্থল, বৈচিত্রতা ও মিউটেশন এর মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দিবে যেটি ভবিষ্যতে কভিড-১৯ মোকাবেলায়  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  

এ গবেষণা কর্মে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য চবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আকতারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।


সর্বশেষ সংবাদ