ডিগ্রির সংখ্যার চেয়ে নাগরিকদের দক্ষতা-প্রয়োগক্ষমতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ: কামরুল হাসান মামুন

কামরুল হাসান মামুন
কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষা আজও অনেকটা একমুখী সড়ক নির্ভর যেই সড়কের গন্তব্য কেবল প্রচলিত কিছু পেশায় নিয়ে যায় যেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, প্রশাসক বা অধ্যাপক হওয়া। সব অভিভাবক স্বপ্ন দেখে সন্তান  ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু বাস্তব অর্থনীতি ভিন্ন কথা বলে—একটি দেশ ডিগ্রির সংখ্যা দিয়ে নয় বরং ডিগ্রির সংখ্যার পাশাপাশি নাগরিকদের দক্ষতা ও প্রয়োগক্ষমতা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রবিবার (১৯ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এসব কথা বলেন তিনি। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য কামরুল হাসান মামুনের ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা  হলো: 

সবাইকে কেন অনার্স মাস্টার্স পড়তে হবে? বরং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কোনো ‘দ্বিতীয় বিকল্প’ নয় এটি হওয়া উচিত সমান মর্যাদার ও অপরিহার্য মূল ধারার শিক্ষার সমান্তরাল আরেকটি পথ। এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখে এমন বাস্তব দক্ষতা অর্জন করবে যেমন বিদ্যুৎ ও ইলেকট্রনিক্স, যন্ত্রপাতি মেরামত, নির্মাণশিল্প, আইসিটি, রেফ্রিজারেশন, নার্সিং, কৃষি এবং আরও অসংখ্য ক্ষেত্র—যেগুলোর ওপর একটি দেশের শিল্প ও সেবাখাত নির্ভর করে। বিশ্ব যখন দ্রুত অটোমেশন, রোবোটিক্স ও উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনে এগোচ্ছে, তখন দক্ষ প্রযুক্তিশ্রমিকের চাহিদা কমছে না—বরং বহুগুণে বাড়ছে। দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া কোনো দেশই টেকসই শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ বা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ধরে রাখতে পারে না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত জানেন? প্রায় ৩০ লক্ষ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোতে শিক্ষক নাই, শ্রেণীকক্ষ নাই, ল্যাব নাই মানে মানসম্মত লেখাপড়ার কিচ্ছু নাই। এটি আমাদের সরকারেরা করেছে অসৎ উদ্দেশ্যে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যেন বেকার না হয়ে ছাত্র হিসাবে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করতে। এতে বেকারের পরিসংখ্যানটা ছোট হয়। চাকরি প্রত্যাশীদের সংখ্যা কম হয়। এইসব কখনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না বরং দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক সমস্যা তৈরি করে।    

জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে কারিগরি শিক্ষা “শেষ ভরসা” নয়—এটি জাতি গঠনের ভিত। সেখানে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষার পর পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণে প্রবেশ করে, কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে দক্ষ পেশাজীবী হয়ে ওঠে এবং সমাজে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পায়। আর পড়াশুনা শেষে উচ্চ বেতনের চাকুরী পায় কিংবা নিজেরাই সার্ভিস সেন্টার খুলে মানুষকে সার্ভিস দিয়ে অত্যন্ত ভালো উপার্জন করে। জার্মানির ‘ডুয়াল সিস্টেম’—যেখানে শ্রেণিকক্ষের পাঠ আর শিল্পখাতে বাস্তব প্রশিক্ষণ একসঙ্গে চলে—এখন বিশ্বের অনুসরণীয় মডেল।

জার্মানিতে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৫০–৬০% শিক্ষার্থী কারিগরি বা বৃত্তিমূলক ধারায় যায়। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুররে প্রায় ৪০–৪৫%। ওইসিডি দেশগুলো: গড় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের মতো দেশে এই কারিগরি খাতটি মারাত্মকভাবে অবহেলিত। অথচ আমাদের শিল্পায়ন বিকাশমান। আমাদের বিপুল তরুণ জনসংখ্যা আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান—সেখানে অন্তত ৪০–৫০% শিক্ষার্থীকে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক ধারায় উৎসাহিত করা যুক্তিযুক্ত করতে পারলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান হবে অন্যদিকে দেশের ভেতরের শিল্পক্ষেত্র যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি বিদেশে কর্মসংস্থানের বাজারেও প্রতিযোগিতা বাড়বে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অপ্রয়োজনীয় ভর্তির চাপও কমবে।

সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা দার্শনিক হতে হবে না। একটি সমাজের টিকে থাকার জন্য ভারসাম্য দরকার। ডাক্তার রোগ সারায়, ইঞ্জিনিয়ার নির্মাণ করে, দার্শনিক চিন্তার দিগন্ত খুলে দেয়— কিন্তু টেকনিশিয়ানই নিশ্চিত করে যেন আলো জ্বলে, যন্ত্র চলে, আর জমি ফসল দেয়।
যখন সবাই একই পেশায় দৌড়ায়, তখন অর্থনীতি হয় ভারসাম্যহীন— ডিগ্রি বাড়ে, দক্ষতা কমে। ফলাফল আমরা প্রতিদিন দেখি— বেকার স্নাতকের ভিড়, শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের সংকট, আর নিজেদের কারখানায় বিদেশি টেকনিশিয়ানের ওপর নির্ভরতা।

কারিগরি শিক্ষা হলো অ্যাকাডেমিক জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব উৎপাদনের সেতুবন্ধন— যা মানবসম্পদকে প্রকৃত কর্মক্ষমতায় রূপান্তরিত করে। এই ভারসাম্য ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য ও অকার্যকারিতা আরও বাড়বে। তাই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কারিগরি শিক্ষা নীতি, যার মূল লক্ষ্য হতে পারে— নির্দিষ্ট অনুপাত নির্ধারণ: ২০৩৫ সালের মধ্যে সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার মধ্যে ৫০:৫০ ভারসাম্য স্থাপন। গুণগত মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা: আধুনিক ল্যাব, দক্ষ প্রশিক্ষক ও শিল্প-সংগত পাঠ্যক্রম।

বৃত্তি, স্টাইপেন্ড, উচ্চতর প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে ভর্তি-সুবিধা ও উচ্চ মানের শিক্ষক নিয়োগ ও ল্যাব সুবিধা বাড়ানো। মানসিকতার পরিবর্তনে প্রচারণা ও গণসচেতনতা জরুরি। কারিগরি শিক্ষা কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং সফলতার আরেক পথ। মানসিকতার পরিবর্তনই মূল চাবিকাঠি।


সর্বশেষ সংবাদ