ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো, তবে অধিকাংশের নেই প্রস্তুতি

বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের লোগো
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের লোগো  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) দেশের ইতিহাসে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ডাকসুর নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল দৃশ্যমান। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ, যা ছিল টানা ২৮ বছর পরের একটি ঐতিহাসিক আয়োজন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০২০ সালের ২২ জুন সেই কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এরপর থেকে ডাকসু নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত বছরের ৫ আগস্টের পর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও অনশনের মুখে অবশেষে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ১০ সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়। কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাবি প্রশাসনের এমন পদক্ষেপে ক্যাম্পাসে সক্রিয় হচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো। নির্বাচন কেন্দ্রীক কিছু সংগঠনকে ইতিমধ্যে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে ছাত্রদলসহ অনেক ছাত্রসংগঠনের এই মুহূর্তে নির্বাচনকে ঘিরে নেই প্রস্ততি। তাদের আবার অনেকে এখনো কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, ‘‘ডাকসু নিয়ে এখনো তেমন কোন দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ছাত্রদল থেকে কারা নির্বাচনে আসছেন তা এখনো ঠিক করা হয়নি।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘এখনো ডাকসু নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নেই‌। ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যাকাণ্ডের বিচার‌‌ এখনো হয়নি‌, সেদিন ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ককটেল ফাটানো হলো এবং ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে ককটেল উদ্ধার করা হলো। ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে।’’

ঢাবি শাখা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‌“ঢাবি প্রশাসন ১০ সদস্যে কমিশন গঠনসহ যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা আশানিয়া দিক। আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই। ছাত্রসংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। আমরা চাই ক্যাম্পাসে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক। শিক্ষাঙ্গনে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হোক। এমনকি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব তৈরি হোক। এতে তাদের দাবি-দাওয়াগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে।”

তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র সংগঠন হিসেবে ডাকসু নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করব। শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে, কীভাবে আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে যায়, এসব বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। এমনকি আমরা প্যানেল আকারেও কাজ করছি। এ ছাড়াও নিজ প্যানেল গুছানোসহ নিজ সংগঠনসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের ব্যক্তি ও ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি।”

ঢাবি শাখা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঈদ পরবর্তী সাক্ষাৎ

শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, “ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় ছাত্রদলের প্রস্তাবনাগুলোকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল সময়ের চাহিদার আলোকে নারী ও সমতা বিষয়ক সম্পাদক এবং ধর্ম ও সম্প্রীতি বিষয়ক সম্পাদক পদসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা। ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে আমরা এই যৌক্তিক প্রস্তাবনাগুলো উত্থাপন করেছিলাম।”

ছাত্রশিবির সভাপতি আরও বলেন, ‘‘একটি সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কত দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা যুক্ত করার আহ্বান জানায় ছাত্রশিবির। ডাকসু নিয়মিত অনুষ্ঠানের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা আমলে নেয়নি। ছাত্রদল প্রস্তাবিত অনেক নতুন সম্পাদক পদ সৃষ্টি করা হলেও সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ”

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল রাজনীতির গুণগত সংস্কার। সে লক্ষ্যে ডাকসু নির্বাচনে সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারত। এর মাধ্যমে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসত। নেতা হওয়ার জন্য বছরের পর বছর ইয়ার ড্রপ দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করা যেত। কিন্তু শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই বয়সসীমার বাধ্যবাধকতাও বাতিল করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা উপেক্ষিত হয়েছে। এতে নিয়মিত অধ্যয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বের অযাচিত দৌরাত্ম্য এবং শিক্ষা-অনুপযোগী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি।

ফরহাদ বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন গঠনেও নির্দিষ্ট একটি শিক্ষক সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে; ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিটি ধাপে সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ঘোষণার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও রোডম্যাপ প্রকাশ বা দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’’

‘‘যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে, সেহেতু আমরা আশাবাদী যে প্রয়োজনীয় অবশিষ্ট সংস্কার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সম্ভব হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক মনোভাব একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি তবে তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়ে কিনা— এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠছে।’’

ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি সংসদের সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, ‘‘ডাকসু নিয়ে আমরা এখনো কোন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নিইনি। তাছাড়া আমরা ডাকসুতে অংশগ্রহণ করব কিনা সেটাও একটা বিষয়। কেননা ডাকসু নিয়ে আমরা কয়েকটি মৌলিক প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। যেমন-ডাকসুর যিনি সভাপতি হবেন তিনি অছাত্র হতে পারবেন না। অর্থাৎ কোন শিক্ষককে আমরা ডাকসুর সভাপতি হিসেবে দেখতে চাই না। তাছাড়া যিনি সভাপতি হবেন তার একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতার পক্ষে আমরা না। এছাড়া আমরা চেয়েছিলাম অনুষদভিত্তিক নির্বাচন হোক। কেননা আমরা দেখছি অনেক শিক্ষার্থীই আবাসিক না। তাই অনুষদ ভিত্তিক হলে সবাই এর সাথে যুক্ত থাকতে পারবে। এই বিষয়গুলো আমরা প্রস্তাবনা করলেও এর কোনোটাই বাস্তবায়ন দেখছি না।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘সর্বশেষ ডাকসুতে আমরা অংশগ্রহণ করেছি ঠিক‌ই তবে সেই ডাকসু নির্বাচন ছিল প্রহসনের নির্বাচন। আমরা দ্বিতীয়বার সেই ভুল আর করতে চাই না‌। এবারের ডাকসুতে আমরা শুরু থেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।” 

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাফিকুজ্জাম ফরিদ বলেন, “ডাকসু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের অন্যতম প্রধান শর্ত। আমাদের সংগঠন ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সবসময় সোচ্চার ছিল। আমরা আমাদের তরফ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমাদের জোটসঙ্গীদের সাথেও কথা চলছে কীভাবে ডাকসুতে আমরা অংশগ্রহণ করব। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে। এখনি নির্দিষ্ট করে কিছু  বলা যাচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে সব জানিয়ে দেব।”

মেয়েদের হলের সেনেটারী ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন সংস্কারের উদ্যোগ ছাত্র অধিকার পরিষদের

ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, “আমরা এতোদিন ডাকসু নিয়ে অনিশ্চয়তার ভেতরে ছিলাম। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করছি অতি দ্রুত বাকি কাজগুলো প্রশাসন করবে।”

তিনি আরো বলেন, “ডাকসুকে বানচালের ষড়যন্ত্র আগেও ছিল। এখনো আছে। তাই শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান থাকবে নিরাপদ ক্যাম্পাস বিনির্মাণে এসব ষড়যন্ত্রকারী রুখে দিতে হবে। যারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখিয়ে ডাকসু থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে তাদের বলব, যেসব শিক্ষার্থীরা স্নাইপারের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল তাদেরকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।”

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতির বিষয়ে জানতে কমিশনের সঙ্গে আমরা শিগগিরই দেখা করব। এ ছাড়াও সর্বশেষ ডাকসুর নির্বাচনে আমরা একক প্যানেল দিয়েছিলাম, এবারও তা হবে। তবে বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজন হলে জোটগত প্যানেলের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি।”

ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি আরমানুল হক বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের জন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি। তবে জাতীয় নির্বাচনের যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়াও ঢাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা জড়িত তাদের বিচার করতে হবে এবং তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্যাম্পাসে অপরাধীও থাকবে আবার ডাকসু নির্বাচনও হবে, বিষয়টা কেমন যেন হয়ে গেল না?”

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাবি শাখার সভাপতি নাজিয়া হাসান রাশা বলেন, “একক প্যানেলে ডাকসু নির্বাচনের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে নির্বাচন পরিস্থিতির আলোকের বাম সংগঠনগুলো মিলে জোট প্যানেল করা হতে পারে। পাশাপাশি নির্বাচনকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণসংযোগ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ডাকসুর নির্বাচনী খসড়ায় ছাত্রসংগঠনগুলো একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল এবং সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসার কথাও ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বসেনি এবং সিন্ডিকেট মিটিংয়ে তা পাস করিয়ে নেয়। নির্বাচনের আগেই প্রশাসন একটি অগণতান্ত্রিক আচরণ করে, যা কাম্য নয়।”


সর্বশেষ সংবাদ