ঢাবি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তায় চালু হচ্ছে ‘ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভৌগোলিক এলাকা ও আশপাশ খোলামেলা হওয়ায় প্রতিদিন প্রচুর যানবাহন চলাচল করে। পাশাপাশি চারপাশে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এসব কারণে এখানে প্রতিদিন জনসমাগম ঘটে। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘটে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। ট্রাফিক দুর্ঘটনা তো আছেই।

এ ছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় রীতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরেদের উৎপাতে শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হন। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা।

এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এবার ‘ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

যা বলছেন শিক্ষার্থীরা
শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দিনের বেলায় ক্লাস করে ফুটপাত ধরে হাাঁটার সময় মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরেদের আচরণে আমাদের বিব্রত হতে হয়। প্রায় শোনা যায় অনেক শিক্ষার্থী তাদের হয়রানির শিকার হন। টাকাপয়সা চেয়ে না পেয়ে থুতু ছুড়ে মারার ঘটনাও শুনেছি। বিশেষ করে সুফিয়া কামাল হল ও কার্জন হলের আশপাশে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের উৎপাত বেশি।

প্রশাসনের উদ্দেশে তিনি বলেন, শুধু দিনে নয়, যেহেতু হলের গেট বন্ধ হয় রাত ১০টায়, আমাদের নানা প্রয়োজনে সন্ধ্যার পর বের হতে হয়। তখন ভয় কাজ করে বেশি। কোথাও এ ধরনের পরিস্থিতি কেউ সহ্য করবে না। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এলাকায় এ অবস্থা থাকে তাহলে সেখানে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়? আমরা আশা করব প্রশাসন এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থী আফরিন বলেন, ক্যাম্পাসে মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরেরা অবস্থান করে। এতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। বিভিন্ন সময় আমাদের হলের সামনেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। প্রায় শোনা যায়, নারী শিক্ষার্থীদের দিকে এ ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীন কেউ ছুটে এসেছে, তাকে খামচি দিয়েছে। তাদের থাকার জায়গা তো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা না। দ্রুত তাদের ক্যাম্পাস থেকে সরাতে হবে।

যানবাহনের বিষয়ে এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতিদিন বহিরাগতদের আগমন ও অসংখ্য যানবাহন প্রবেশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ  পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত থাকে না। মেয়ে শিক্ষার্থীদের হয়রানি, মাদকসেবীদের আশ্রয়স্থলসহ নানা কারণে ঢাবি ক্যাম্পাস অনেকের কাছে পর্যটন স্থা হয়ে গেছে। স্বল্পসংখ্যক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর চাওয়া দ্রুত এসব নিয়ন্ত্রণ করা হোক।

দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবারও প্রশ্ন উঠেছে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে। এ কারণে এবার ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত শুক্রবার নিরাপত্তাপ্রহরীদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক দেওয়া হয়। পাশাপাশি হাইকোর্ট মোড় ও শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন বক্সেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাপ্রহরী থাকার জন্য লোকবল নিয়োগ দিতে রবিবার প্রক্টর অফিস থেকে ছয়জন নিরাপত্তাপ্রহরী চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অনেক চেষ্টা করেও নানা সংকট ও জনবলের অভাবে সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে প্রক্টর বলেন, প্রক্টরিয়াল বডির ভ্রাম্যমাণ টিমে জনবল নিয়োগ, ক্যাম্পাসে ছয়টি সিকিউরিটি বক্সে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাপ্রহরী থাকাসহ শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে ‘ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস’ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। প্রতিদিন ১২ জন করে শিক্ষার্থী এ দায়িত্ব পালন করবে। এখন পর্যন্ত ৫০০ শিক্ষার্থী আগ্রহ দেখিয়ে ফরম জমা দিয়েছে। যার যেদিন ক্লাস থাকবে না, সেদিন তাকে যুক্ত করা হবে।

প্রশিক্ষণ ও পারিশ্রমিক
প্রক্টর বলেন, ক্যাম্পাসে আগে থেকেই ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য চালু আছে ‘স্টুডেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড সাপোর্ট ইউনিট’। এবার এটাকে রি-অরগানাইজ করে এই ইউনিটের অধীনে শিক্ষার্থীরা কাজ করবে। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে আট ঘণ্টা কাজ করতে পারবে। কাজে যোগদানের আগে তাদের ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম ও ইন্ডাকশন ট্রেনিং দেওয়া হবে। তাদের থাকতে নির্দিষ্ট পোশাক ও আইডি কার্ডের ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের কর্মঘণ্টা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে।

দেড় বছর আগে নেওয়া হয় যে উদ্যোগ
গত বছরের ১৬ জুন ঢাবির পাঁচটি প্রবেশদ্বারে (রাসেল, নীলক্ষেত, পলাশী মোড়, শাহবাগ, হাইকোর্ট মোড়, শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার ও নিশ্চিত করতে সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভেইল্যান্স বক্স উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান। তবে তা শুধু উদ্বোধন পর্যায়েই থাকে। সেখানে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। চার মাস খালি পড়ে থাকে বক্সগুলো। পরে ওই বছরের নভেম্বরে শুধু তিনটি বক্সে (শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী মোড়) নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে ৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় এই বক্সগুলো ভেঙে ফেলে আন্দোলনকারীরা।

এ বিষয়ে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আগে পাঁচটি প্রবেশদ্বার ছিল। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনেসহ মোট ছয়টি প্রবেশদ্বারে কাজ করবে টিম। প্রতিটা চেকপোস্টে আমাদের নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসিয়াল টিম আছে, তাদের একজন থাকবে চেকপোস্টে, একজন থাকবে মোবাইল টিমে। আর প্রতিটা চেকপোস্টে দুজন শিক্ষার্থী থাকবে। ছয়টি প্রবেশমুখে ‘বার’ স্থাপন করা হবে। আমরা চেষ্টা করব সবগুলোকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনতে।

মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের নিয়ন্ত্রণে ভিন্ন উদ্যোগ
ক্যাম্পাসে মানসিক ভারসাম্যহীন, মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের অবস্থানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ভীতিকর হয়ে উঠেছে। প্রায় শোনা যায় নারী শিক্ষার্থীদের দিকে তেড়ে আসা, তাদের খামচি দেওয়ার ঘটনা। এ ধরনের ব্যক্তিদের বিষয়ে এবার ভিন্ন পথে হাঁটছে প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেন, আগে সমাজ্যকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের প্রক্রিয়াগুলো অনেক জটিল। তবে আমরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা একবার এসে মাদকাসক্তদের ধরে আইনি প্রক্রিয়ায় চালান করে দেয় মিরপুরের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এবার আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে একজন ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছি। এখন থেকে এদের নিয়ন্ত্রণে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আমাদের টিম কাজ করবে।

যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সড়কগুলোতে ট্রাফিক সামলানোর জন্য কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। রাস্তা পার হওয়ার জন্য নেই কোনো ফুট ওভারব্রিজ। এ জন্য ওই এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং বহিরাগত যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ চান শিক্ষার্থীরা।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষার্থী জুবায়ের বলেন, বহিরাগত যানবাহন ও মানুষ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের উচিত ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসিটিভি এবং কর্মক্ষম ও সর্বোচ্চ দক্ষ একটা প্রশাসনিক টিম তৈরি করা। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক হটলাইনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। ক্যাম্পাসে ছুটির দিনগুলোতে যানবাহন প্রবেশ কমিয়ে দিতে পারলে ক্যাম্পাস তূলনামূলক ভালো থাকবে। তারা চান শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে।

এ বিষয়ে প্রক্টর বলেন, প্রতিটা প্রবেশমুখে ‘যানবাহন প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সংবলিত বোর্ড দেওয়া হবে। যাতে দূর থেকে চালকরা দেখতে পারে। এরপরও যদি কেউ জোর করে ঢুকতে চায়, সেক্ষেত্রে কী কী নির্দেশনা দেওয়া আছে, এ ব্যাপারে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বলা আছে কীভাবে তারা কাজ করবে। যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে মোবাইল টিম সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

তিনি আর বলেন, ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস ও সিকিউরিটি বক্সের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও ভারী যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ভবঘুরে ও ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের সরিয়ে আমরাও চাই এটা একটা নিরপাদ স্থান হয়ে উঠুক। এ জন্য আপনাদের সবার সহযোগিতা দরকার।


সর্বশেষ সংবাদ