ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনলাইনে, ছাত্রলীগের রাজনীতি সশরীরে

ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে সংগঠনটির কর্মীরা
ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনে সংগঠনটির কর্মীরা  © টিডিসি ফটো

তীব্র তাপদাহের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি চলছে। অন্যদিকে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পাঠদান করছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইনে পাঠদানের সিদ্ধান্ত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও। তবে ক্লাস অনলাইনে হলেও থেমে নেই ছাত্রলীগের নিয়মিত সভা-সমাবেশ-গেস্টরুম কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাসের মধ্যে সংগঠনটির এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেছে ঢাবি প্রশাসন।

গেস্টরুম বলতে সাধারণ মানুষ বোঝেন এমন একটি রুম, যেখানে অতিথিদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে একটি করে এমন অতিথি কক্ষ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গেস্টরুম নামক এই শব্দকে এখন রূপ দেওয়া হয়েছে নির্যাতন সেলে। যেই নির্যাতন সেলের শিকার প্রতিটি হলের প্রথম বর্ষের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়টির অনলাইন ক্লাসের মধ্যে থেমে নেই সংগঠনটির গেস্টরুম কর্মসূচি। সমানতালে চলছে সশরীরে সংগঠনটির সভা-সমাবেশ কর্মসূচিও। সম্প্রতি ছাত্রলীগের এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে তীব্র গরমে দুজন ছাত্র অচেতন হয়ে পড়েছেন। পরে তীব্র গরমের মধ্যে ছাত্রলীগের চলমান এসব কর্মসূচি নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। ঢাবিতে মেধাবীরা পড়তে এসে এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক, এটা আমরা চাই না। -অধ্যাপক বাছির, প্রাধ্যক্ষ, বিজয় একাত্তর হল

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তীব্র তাপদাহের কারণে অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে অবস্থান করতে বলা হলেও ছাত্রলীগের কর্মসূচি থেকে তারা নিস্তার পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়েই শীর্ষ নেতাদের প্রটোকল দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে হচ্ছে তাদের। কেউ এর ব্যত্যয় করলে শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয়। এছাড়া গেস্টরুমে ‘আচরণ’ শেখানোর নামে অনেক সময় দাঁড় করে রাখা হয়।

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) ডাকসুর সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা

শিক্ষার্থী অচেতন হওয়ার ঘটনার পর সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনটির এসব কর্মসূচি নিয়ে ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমে দুই শিক্ষার্থীর অবচেতন হয়ে পড়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন ‍বিরূপ আবহাওয়া পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হতাহতের ঘটনায় যারা জড়িত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

ছাত্রলীগের পরিচয়ের কারো হাতে যদি কোনো শিক্ষার্থী হেনস্থার শিকার হন, তাহলে আমাকে জানাবেন। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। -তানভীর সৈকত, সাধারণ সম্পাদক, ঢাবি ছাত্রলীগ

গেস্টরুমে কী হয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের ২য় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমবর্ষে আমিও গেস্টরুম করেছি। এটা ছিল একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। কারণে-অকারণে গেস্টরুমে ডাকা হতো। প্রথমত ছাত্রলীগ নেতার প্রটোকল-প্রোগ্রাম এবং ছাত্রলীগ আয়োজিত কোনো প্রোগ্রাম বা কোনো মিছিলে না থাকলে সেদিন রাতে গেস্টরুমে হতো ভয়ানক অবস্থা। যারা ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অনুপস্থিত থাকেন গেস্টরুমে তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল, হেনস্থা এমনকি মারধরের মতো ঘটনাও ঘটে। পাশাপাশি কেউ প্রোগ্রামে গিয়ে সম্পূর্ণ কর্মসূচি না করে চলে আসলে করতে হয় জবাবদিহি।

তানভীর সৈকতের নেতৃত্বে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ কর্মীরা। বৃহস্পতিবার তোলা ছবি

তিনি বলেন, সিনিয়রদের সালাম না দেওয়া, প্রথমবর্ষে নিজ ক্যান্টিনে খাওয়াসহ নানা কারণে গেস্টরুমের নির্যাতন সহ্য করতে হয় প্রথমবর্ষে গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের। নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে হল ছেড়ে বাইরে চলে যান।

তীব্র গরমে গেস্টরুমে অচেতন দুই শিক্ষার্থী
গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) রাত ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমে ছাত্রলীগের গেস্টরুম চলাকালে এক শিক্ষার্থী অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম নিয়ামুল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী।

এদিন বিজয় একাত্তর হলের গেস্টরুমে তীব্র গরমের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জবাবদিহি নিচ্ছিলেন হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাব্বি আহম্মেদের কর্মীরা। রাব্বি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

দিনরাত সমানতালে ক্যাম্পাসে সরব ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর। বুধবার তোলা ছবি

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভুক্তভোগী নিয়ামুল ইসলামকে গেস্টরুমে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তখন তিনি তীব্র গরমে তার শারীরিক অস্বস্তির কথা জানান। তবে তার কথা আমলে নেননি সংগঠনটির নেতারা। পরে এক পর্যায়ে রাত ১০টার দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান ওই শিক্ষার্থী। এ অবস্থায় তার সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তার মাথায় পানি দেওয়া হয়। ‍নিয়ামুল ইসলামের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নিতে চাইলেও তার সহপাঠীরা সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়েন।

ভুক্তভোগী নিয়ামুল ইসলাম বলেন, গেস্টরুমে অতিরিক্ত গরমের কারণে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পরে আমার বন্ধুরা ধরে রুমে নিয়ে আসে এবং মাথায় পানি দেয়। এখন কিছুটা ভালো আছি।

তীব্র দাপদাহের কারণে অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে অবস্থান করতে বলা হলেও ছাত্রলীগের কর্মসূচি থেকে তারা নিস্তার পাচ্ছেন না। -শিক্ষার্থীদের অভিযোগ

এই ঘটনার পরদিন তদন্তের জন্য আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহ মিরানকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে হল প্রশাসন। আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বলা হয়।

এর আগের দিন সোমবারও একই হল এবং বিভাগের মোহাম্মদ আলি শহীদ নামে আরও এক শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে। রাত ২টার দিকে তাকে এবং তার বন্ধুদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গেস্টরুমে ডাকা হয়। কর্মসূচিতে নিয়মিত কেন অংশ নিচ্ছেন না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী অচেতন হয়ে পড়েন।

মধুর ক্যান্টিনে সংগঠনটির পৃথক দিনের কর্মসূচি। বৃহস্পতিবারের ছবি

ছাত্রলীগ কী বলছে
এ বিষয়ে হল ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামতকে উপেক্ষা করে আমরা কিছু বলতে পারবো না। তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো।

গেস্টরুম কেন নেওয়া হয় জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা। সিনিয়র-জুনিয়র এক জায়গায় বসে আলাপ-আলোচনা করতেই পারেন। তবে সেক্ষেত্রে গায়ে হাত তোলা বা নির্যাতন করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের পক্ষ থেকে কর্মীদেরকে মারধরের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, ছাত্রলীগের পরিচয়ের কারো হাতে যদি কোনো শিক্ষার্থী হেনস্থার শিকার হন, তাহলে আমাকে জানাবেন। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

প্রথমবর্ষে আমিও গেস্টরুম করেছি। যারা ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অনুপস্থিত থাকেন গেস্টরুমে তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল, হেনস্থা এমনকি মারধরের মতো ঘটনাও ঘটে। -ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি হলের সাথে সম্পৃক্ত নই। তাই এই বিষয়ে আমি মতামত দিতে পারবো না। হল প্রশাসন চাইলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারে।

বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল বাছির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত। ঢাবিতে মেধাবীরা পড়তে এসে এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক, এটা আমরা চাই না। গতকালের ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সত্যতা মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তরা ভেতরে ভেতরে মীমাংসা করে ফেলেন, যার কারণে ঘটনা সামনে আসে না। তবুও গণমাধ্যমের বরাতে যা জেনেছি তার ভিত্তিতেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। পাশাপাশি আমি ছাত্রনেতাদের সাথেও কথা বলেছি, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

 

সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence