ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কনসার্টে উত্তেজনা শুরু, জগন্নাথ হলে রাতভর চলে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ
- জুবায়ের হোসাইন, ঢাবি
- প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৪৩ PM , আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:১১ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগের দুপক্ষে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে পক্ষগুলোর অন্তত ১৪ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাত আনুমানিক রাত ১২টা নাগাদ এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। পরে রাত আনুমানিক ৪টা পর্যন্ত দুপক্ষে থেমে থেমে চলে এ হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা। হল প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা শুক্রবার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে। এতে গুরুতর আহত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোর্তাজা মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি হয়েছেন সৈকতের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত অপুর্ব চক্রবর্তী নামে হলটির এক নেতা।
রাতে ছাত্রলীগের দুপক্ষের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩-৪ জন আহত হয়েছেন। আমি তাদেরকে রাতেই দেখে এসেছি। তবে এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। -মিহির লাল সাহা, প্রাধ্যক্ষ
এছাড়া দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় পলাশ রায় সৌরভ, অপুর্ব চক্রবর্তী, পল্লব মন্ডল, অর্পণ কুমার বাপ্পি, বিপ্লব পাল, বর্ষণ রয়, কার্তিক কুমার আহত হয়েছেন। এরা সবাই ক্যাম্পাসে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকতের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত। এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ইনানের অনুসারীদের মধ্যে অভিষেক ভাদুড়ি, জয় দাস, অপুর্ব, ধ্রুব, চিন্ময়, রিদ্ধি, অভি ও প্রিতম আহত হয়েছেন।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে জগন্নাথ হলের উদ্যোগে হলটির খেলার মাঠে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়। কনসার্ট চলাকালীন ধাক্কাধাক্কিকে কেন্দ্র করে প্রথমে দুপক্ষের মধ্যে সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এসময় কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করা হয় বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। কনসার্টে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাকর্মী ও ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
হাসপাতালে ভর্তি আহত অপুর্ব চক্রবর্তী
আরও পড়ুন: ২২ ঘণ্টায় তিনবার সংঘর্ষে জড়াল চবি ছাত্রলীগ, থমথমে ক্যাম্পাস
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, সাময়িক উত্তেজনার পর একটি গ্রুপ ঘটনা স্থল ত্যাগ করলে অপর গ্রুপ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ওয়ারফেজ ব্যান্ডের ২য় গান চলছিল। পরবর্তীতে কনসার্টের শেষ মুহূর্তে যখন মমতাজ গান গাচ্ছিল তখন আরেকটি বড় গ্রুপ হলের মাঠে প্রবেশ করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সংগঠনটির শীর্ষ চার নেতা কনসার্ট ত্যাগ করলে শুরু হয় সংঘর্ষ।
এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘আমি দেখলাম কয়েকজন দৌড়ে নতুন বিল্ডিংয়ে উঠে পড়লো। অন্যদিকে পুকুর পাড়ে দেখলাম স্টাম্প, লাঠি, পাইপ নিয়ে শুধু মারামারি চলছে। কিন্তু কে কাকে মারছে সেটি আমি বুঝতে পারিনি।’’
সৈকত ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে তার অনুসারী সুস্ময়, অপুর্ব চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে আমাদের উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। এতে আমাদের প্রায় ৬-৯ জন নেতাকর্মী আহত হন। -রাজিব বিশ্বাস, ইনানের অনুসারী
সংঘর্ষ নিয়ে ভিন্নমত পক্ষগুলোর
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ইনানের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিত রাজিব বিশ্বাস দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সেখানে ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের সাথে হল ছাত্রলীগ নেতা গণেশের একটু ধাক্কা লাগে। গণেশ হল ছাত্রলীগের ইনানের অনুসারী। তাৎক্ষণিক সৈকতের কাছে ক্ষমা চাইলে সৈকত ঘটনার মীমাংসা করে দেন। পরে সৈকত ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে তার অনুসারী সুস্ময়, অপুর্ব চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে আমাদের উপর লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। এতে আমাদের প্রায় ৬-৯ জন নেতাকর্মী আহত হন।
সৈকতের অনুসারী ঋভু মন্ডল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রথমত যখন চার নেতা কনসার্টে এসেছিলেন তখন মমতাজের গান শেষ হয়। এরপর যখন তিন নেতা বের হচ্ছিল, তখন গণেশ ঘোষ তার কর্মীসহ এমন অবস্থা তৈরি করেছে—যাতে সৈকত ভাই বের হতে না পারে। ফলে কর্মীদের মধ্যে একটা ছোটখাটো ঝামেলা তৈরি হলে সৈকত ভাই তাদের সাথে কথা বলে বের হয়ে যান।
তিনি বলেন, সৈকত ভাই বের হয়ে গেলে জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে হট্টগোল তৈরি হয়। পরে আমরা আমাদের কর্মীদের নিয়ে ভেতরে চলে আসি। আনুমানিক রাত দুইটার দিকে হলের সভাপতি কাজল দাসের অনুসারী ও সাধারণ সম্পাদক অতুনু বর্মনের অনুসারীরা একত্রিত হয়ে আমাদের উপর হামলা করে। এতে ইনান ভাইয়ের তিনটি গ্রুপ ও সাদ্দাম ভাইয়ের দুটি গ্রুপের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। তারা একত্রিত হয়ে নতুন ভবনের সেক্রেটারি ব্লকের তিনতলা ভাঙচুর করে চতুর্থ তলায় যেতে চায়। সেখানে কয়েকজন আহত হন। হামলায় আমাদের অন্তত ৮ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
মাতাল অবস্থায় গণেশ আমার গায়ের উপর পড়লে সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে আমি মীমাংসা করে দিয়ে চলে আসি। পরে জানতে পারি, আমার গ্রুপের কর্মীদের উপর ফের হামলার ঘটনা ঘটে। -সৈকত, সম্পাদক, ঢাবি ছাত্রলীগ
ঋভু মন্ডল আরও বলেন, এই হামলায় হলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ রাজিব বিশ্বাস, গণেশ ঘোষ, সবুজ মণ্ডলের গ্রুপ উপস্থিত ছিলো। এদের হাতে স্টাম্প, রড, কাঠের টুকরো, এসএস পাইপ ছিলো। পাশাপাশি সাদ্দাম ভাইয়ের দুজন ক্যান্ডিডেট অরিত্র নন্দী ও সৌরভ চক্রবর্তীর একহাতে রড ও অন্য হাতে মদের বোতল ছিলো।
সৈকতের অনুসারী আহত অপুর্ব চক্রবর্তী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। যাদের সাথে চলাফেরা করি, খাওয়া-দাওয়া করি—তারাই দেখি আজ আঘাত করছে। এই আক্রমণ অত্যন্ত লজ্জাজনক।
তিনি বলেন, আমি আমার কর্মীদেরকে ভেতরে যেতে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে রাজিব বিশ্বাস ও গণেশ এসে আমার মাথায় ও চোখে রড দিয়ে আঘাত করে। ফলে আমার চোখের কোণে কেটে যায় ও মাথা ফেটে যায়। আমি তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে চলে আসি। তার পরে আমি আর জানি না।
আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। হামলা-মারামারি হয়েছে—এমনটি আমি শুনিনি। তবে জানতে পেরেছি, কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। -ইনান, সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
কেন তার উপর এ হামলার হয়েছে, এমন প্রশ্নে অপুর্ব বলেন, আমি নতুন করে হলে সৈকত ভাইয়ের অনুসারীদেরকে নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরি করেছি। সেই গ্রুপে কর্মী সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য গ্রুপ থেকে আমার গ্রুপে কর্মী চলে আসায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তার ফলেই হয়তো এই আক্রমণ।
জানতে চাইলে জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অতুনু বর্মন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার এবং সভাপতির উপরে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কনসার্ট শেষে আমি এবং সভাপতি দুজন বাইরে খাওয়া-দাওয়া করতে গিয়েছিলাম। পরে হলে এসে দেখি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। পরবর্তীতে আমি এবং সভাপতি কাজল দাসসহ প্রভোস্ট স্যারকে নিয়ে ঝামেলা মীমাংসা করে দিই।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। হামলা-মারামারি হয়েছে—এমনটি আমি শুনিনি। তবে জানতে পেরেছি, কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মারামারির বিষয়ে আমি এখনও কিছু শুনিনি। এমন কিছু হয়ে থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
আনুমানিক রাত দুইটার দিকে হলের সভাপতি কাজল দাসের অনুসারী ও সাধারণ সম্পাদক অতুনু বর্মনের অনুসারীরা একত্রিত হয়ে আমাদের উপর হামলা করে। -ঋভু মন্ডল, সৈকতের অনুসারী
ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মাতাল অবস্থায় গণেশ আমার গায়ের উপর পড়লে সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে আমি মীমাংসা করে দিয়ে চলে আসি। পরে জানতে পারি, আমার গ্রুপের সাথে পূর্ব শত্রুতার জেরে হলের অন্যান্য কয়েকটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে তাদের উপর হামলা করেছে। বাইরের কাদেরকে হলে আনা হয়েছে, তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাতে ছাত্রলীগের দুপক্ষের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩-৪ জন আহত হয়েছেন। আমি তাদেরকে রাতেই দেখে এসেছি। তবে এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। হলেও ভাঙচুর হয়েছে। শুনেছি, একজন হল থেকে লাফও দিয়েছেন। তাকেও দেখে এসেছি, সেও আপাতত সুস্থ আছে।