রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বিজ্ঞপ্তিতে দুশোর বেশি ভুল

রাবি ক্যাম্পাস
রাবি ক্যাম্পাস  © ফাইল ছবি

শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্য অবদান রেখে চলেছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভিন্ন বিভাগের জারীকৃত অধিকাংশ বিজ্ঞপ্তি (নোটিশ), অফিস আদেশ, চিঠির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে অসংগতি ও ভুল বানানের ছড়াছড়ি। এসব বিজ্ঞপ্তিতে ভুল বানান লেখা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এমন অসংগতি ও বানান ভুল ভীষণভাবে অপ্রত্যাশিত ও লজ্জার বিষয় বলছেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা।

অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি—
চলতি বছরের ১৫ই জানুয়ারিতে জারীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ৮১টি বানান ভুল ও অসংগতি চিহ্নিত করেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। 

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, ওই নোটিশের অসংগতি ও ভুল বানানগুলো হলো তারিখঃ, ১৫-০১-২০২৪, আরবী, সময়সূচী, নেয়া, যোগ্যতাঃ, আসন সংখ্যাঃ, সময়সুচি, ক্লাশ, শুরুঃ, ভতিঃ, ফিঃ, টাঃ, বিঃ দ্রঃ, ফরম, একাডেমিক, এচ্চ মাধ্যমিক এর, মার্কসীট সহ, ডীন, জীব বিজ্ঞান, ফিশারীজ, এন্ড, রা. বি., শাহ মখদুম হল, মাদার বখশ হল, উর্দূ, ফার্মেসী, হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা, লোক প্রশাসন, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট, এগ্রোনমী এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, ফিশারীজ। 

উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো তারিখ:, ১৫-০১-২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ/খ্রি./তারিখ, আরবি, সময়সূচি, নেওয়া, যোগ্যতা:, আসন সংখ্যা:, সময়সূচি, ক্লাস, শুরু:, ভর্তি:, ফি:, টাকা, বি. দ্র., ফর্ম, অ্যাকাডেমিক, উচ্চ মাধ্যমিক-এর/মাধ্যমিকের, মার্কসিটসহ, ডিন, জীববিজ্ঞান, ফিশারিজ, অ্যান্ড, রাবি, শাহ মখ্দুম হল, মাদার বখ্শ হল, উর্দু, ফার্মেসি, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা, লোকপ্রশাসন, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট, এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, ফিশারিজ। 

উপ-রেজিস্ট্রার এ.এইচ.এম. আসলাম হোসেন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি—
গত বছরের ২৭শে নভেম্বর জারীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার এ.এইচ.এম. আসলাম হোসেন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ৩১টি বানান ভুল ও ১৬ জায়গায় অসংগতি চিহ্নিত করা হয়েছে। 

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, এই নোটিশের ভুল বানানগুলো হলো সাধারন, মিক্ষার্থীদের, ফরমে, আহবান, আবদনের, ওয়েবপেইজ, ইংরেজী, ফারসী, আরবী, ফার্মেসী, টুরিজম, লাইব্রেরী, এগ্রোনমী, ফিশারীজ, ভেটেরিনারী, হাজবেন্ড্রী, এপ্লাইড, একাডেমিক এবং এন্ড। এই নোটিশের অসংগতিগুলো হলো ফোনঃ, তারিখঃ, কলেজ মেডিকেল, ( শিক্ষাবর্ষ, বৃত্তি সংক্রান্ত, করুনঃ, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১.সভাপতি, প্রাণ রসায়ন, হিসাব বিজ্ঞান, তথ্যব্যবস্থাপনা, লোক প্রশাসন, কারুশিল্পকলার ইতিহাস, রা. বি., স্বাক্ষরঃ/-। 

উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর  প্রমিতরূপ হলো সাধারণ, শিক্ষার্থীদের, ফর্মে, আহ্বান, আবেদনের, ওয়েবপেজ, ইংরেজি, ফারসি, আরবি, ফার্মেসি, ট্যুরিজম, লাইব্রেরি, এগ্রোনমি, ফিশারিজ, ভেটেরিনারি, হাজবেন্ড্রি, অ্যাপ্লায়েড, অ্যাকাডেমিক, অ্যান্ড, ফোন:, তারিখ:, কলেজ, মেডিকেল, (শিক্ষাবর্ষ, বৃত্তিসংক্রান্ত, করুন:, ৩০শে নভেম্বর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ/খ্রি., ১. সভাপতি, প্রাণরসায়ন, হিসাববিজ্ঞান, তথ্য ব্যবস্থাপনা, লোকপ্রশাসন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস, রাবি, স্বাক্ষর। 

মন্নুজান হলের প্রাধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত নোটিশ—
মন্নুজান হলের আবাসিকতা লাভের নিয়মকানুন প্রসঙ্গে জারীকৃত একটি নোটিশে ২৯টি অসংগতি ও ভুল বানান চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, ওই নোটিশের অসংগতি ও ভুল বানানগুলো হলো এতদ্বারা, শিক্ষা বর্ষে, হল সংশ্লিষ্ট, আবাসিকতার লাভের জন্য, জমা পূর্বক, শামীমা আকতার এর, ফরম, ফরম নেয়ার, হল রেজিস্ট্রেশনকৃত, ছাত্রীদেরকে, হল ছাড়পত্র, তাদেরকে, বিউটি পারভীন এর, আবেদন পত্রের, হবেঃ-, একাডেমিক, উল্লেখিত, প্রত্যয়ন পত্রের, এস.এস.সি, এইচ.এস.সি, হল রেজিস্ট্রেশনের, ০১কপি, রক্ষনাবেক্ষণের।

উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো এতদ্দ্বারা, শিক্ষাবর্ষে, হলসংশ্লিষ্ট, আবাসিকতা লাভের জন্য, জমাপূর্বক, শামীমা আকতার-এর/আকতারের, ফর্ম, ফর্ম নেওয়ার, হলের রেজিস্ট্রেশনকৃত, ছাত্রীদের, হলের ছাড়পত্র, তাদের, বিউটি পারভীন-এর/পারভীনের, আবেদনপত্রের, হবে:, অ্যাকাডেমিক, উল্লিখিত, প্রত্যয়নপত্রের, এসএসসি, এইচএসসি, হলের রেজিস্ট্রেশনের, ০১ কপি, রক্ষণাবেক্ষণের। 

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বৃত্তিসংক্রান্ত একটি নোটিশে ৪৬টি ভুল ও অসংগতি চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ভুল বানানগুলো হলো- শিক্ষা বর্ষে, ১মবর্ষ, শ্রেণীতে, অধ্যায়নরত, পারে নাই, উল্লেখিত, ব্যবস্থা গ্রহণের, অনুরোধ জানানো হলো, বিঃদ্রঃ, Form এর, কর্তপক্ষের, একাডেমিক, তারিখঃ, ০৫/১১/২০২৩, শাহ মখদুম হল, মাদার বখশ হল, রা. বি., আরবী, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ফার্মেসী, এন্ড, হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা, লোক প্রশাসন, ইনফরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট, এগ্রোনমী এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, ফিশারীজ, ভেটেরিনারী এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস। 

উপর্যুক্ত অসংগতি ও ভুল বানানগুলোর প্রমিতরূপ হলো শিক্ষাবর্ষে, ১ম বর্ষ, শ্রেণিতে, অধ্যয়নরত, পারেনি, উল্লিখিত, ব্যবস্থাগ্রহণের , বি.দ্র., Form-এর, কর্তৃপক্ষের, অ্যাকাডেমিক, তারিখ:, ০৫/১১/২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ/খ্রি./তারিখ, শাহ মখ্দুম হল, মাদার বখ্শ হল, রাবি, আরবি, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, ফার্মেসি, অ্যান্ড, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা, লোকপ্রশাসন, ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট, এগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন, ফিশারিজ, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস। বাক্য বিবেচনায় 'অনুরোধ জানানো হলো' পরিহার্য।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ব্যবহৃত হবে। কারণ বাংলায় উচ্চারণগত দীর্ঘস্বর নেই। ই ঈ এবং উ ঊ প্রভৃতির উচ্চারণ অভিন্ন। তাই অতৎসম (দেশি, বিদেশি) শব্দে ঈ-কার নিষ্প্রয়োজন। উপর্যুক্ত চারটি নোটিশে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে ২৭টি শব্দের ক্ষেত্রে। একই নোটিশে এই নিয়মের বারবার ব্যত্যয় ঘটেছে। তবে পুনরাবৃত্তি এড়াতে সেগুলো প্রতিবেদক উল্লেখ করেনি। 

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট ‘গ’-এ বাংলা তারিখ ও সময় লেখার নিয়ম বিধৃত। বিশেষ দ্রষ্টব্যে বলা হয়েছে: অ্যাক বৈশাখ, অ্যাগারো জ্যৈষ্ঠ, শোলো ডিসেম্বর, পোঁচিশ বৈশাখ প্রভৃতি উচ্চারণ অশুদ্ধ। শুদ্ধ ও মান্য রীতি: পয়লা বৈশাখ, অ্যাগারোই জ্যৈষ্ঠ, শোলোই ডিসেম্বর, পোঁচিশে বৈশাখ প্রভৃতি। উপর্যুক্ত চারটি নোটিশে সকল তারিখের ক্ষেত্রে  এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। 

বিসর্গ (ঃ) কোনো যতিচিহ্ন নয়, এটি বাংলা বর্ণমাালার একটি স্বাধীন বর্ণ, এর নিজস্ব উচ্চারণ আছে। পদান্তে অবস্থিত বিসর্গ বর্ণের উচ্চারণ: হ্্। যতিচিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত কোলন ( : ) বা সংক্ষেপণচিহ্নের (.) স্থলে বিসর্গ বিধেয় নয়। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে ২৬ জায়গায়। 

'সংক্রান্ত, পূর্বক, এর' এই শব্দগুলো পূর্ববর্তী শব্দের সাথে সেঁটে বসার নিয়ম থাকলেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে কয়েক জায়গায়। তাছাড়া 'নেওয়া' অর্থে নেয়া ও 'দেওয়া' অর্থে দেয়া ব্যবহার করা হয়েছে। যা চরম ভুল ও হাস্যকর অর্থ তৈরি করে। কারণ 'দেয়া ও নেয়া' শব্দদ্বয়ের নিজস্ব অর্থ আছে। 

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান [পরিমার্জিত সংস্করণের তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ (এপ্রিল ২০১৮)] বলছে, ‘ডিগ্রি’-র নামের বানানের সংক্ষেপণে ডট (.) থাকবে না। লিখতে হবে ডট (.) ছাড়া এবং নিরেটভাবে। যেমন:  
এইচএসসি, এসএসসি, এমএ, এমএসসি, এমডি, এমকম, বিএ, বিএল, বিএসসি, বিকম। ব্যতিক্রম: এম বি বি এস। অন্যান্য সংক্ষেপণের ক্ষেত্রেও ‘মুণ্ডমাল শব্দের’ ন্যায় একই রীতি অনুসৃত হবে। যেমন: এসএমএস, ঢাবি, রাবি, চবি, ইউএনও। এই নিয়মের তোয়াক্কা না করে সব জায়গায় রা. বি. লেখা হয়েছে। যা চরম ভুল। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি জায়গায় বানানে ভুল হওয়া লজ্জার বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন রাবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বানানে ভুল করা বড়ই দুঃখজনক। একই সাথে এটি লজ্জার বিষয়, পরিতাপের বিষয়। তবে কেউ বাংলা একাডেমির বানানরীতি মানে, আর কেউ পুরাতন বানানরীতি মানে। তারপরেও মৌলিক শব্দের বানানে প্রচুর ভুল থাকে। দুঃখের বিষয় প্রমোটি অফিসারদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভরে গেছে। এখন পিওন-দারোয়ানও ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়ে যাচ্ছে। স্বয়ং রেজিস্ট্রারই তো বানান জানেন না দেখি। ফলে ভুল থেকেই যাচ্ছে। 

মূলত অফিসারদের অজ্ঞতার কারণে এমনটা হচ্ছে। সেটাতে ভুল আছে কি না রেজিস্ট্রারের দেখে দেওয়ার কথা। কিন্তু রেজিস্ট্রারও হয়তো ভাষাটা জানেন না। ভুল করেছেন রেজিস্ট্রার, লজ্জা পাচ্ছি আমরা। আমি তো লজ্জা পাচ্ছি। তাহলে আমি আমার শিক্ষার্থীকে কীভাবে শেখাব। প্রশাসনের উচিত এগুলোর শুদ্ধাভিযান করা। জানি না প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবেন কি না। 

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, এগুলো আমারও নজরে এসেছে এবং তাঁদের ভুল না করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। তাঁদের বলেছি, বিজ্ঞপ্তিতে কেন ভুল বের হলো? বানান না জানলে ডিকশনারি দেখে নাও। বিজ্ঞপ্তির ভুলগুলো তুলে ধরাই তিনি এই প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ