‘আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবছে না’— ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে থাকা ঢাবি শিক্ষার্থী

মুহসীন হলের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে
মুহসীন হলের ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে   © সংগৃহীত

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আসলে কেউ ভাবছে না’। কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের এক ছাত্রী। যদিও  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে বাজেট না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ আবাসিক হলগুলোর সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসেন বিভিন্ন মফস্বল শহর বা গ্রামাঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাই থাকার জন্য হল ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তাদের হাতে থাকে না। ফলে নানা প্রতিকুলতার মাঝেও হলই হয় তাদের একমাত্র আবাসন। কিন্তু এই আবাসিক হলগুলো বেহাল অবস্থায় রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঝুকিপূর্ণ ভবন দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

উচ্চশিক্ষা এই প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি হল সবসময়ই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আলোচনায় থাকে তার মধ্যে অন্যতম শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও মেয়েদের বাংলাদেশ - কুয়েত মৈত্রী হল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল। প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতার এ হলের অবস্থান আজিমপুর কবরস্থান এবং বঙ্গমাতা হলের পাশে। হলের সিকদার মনোয়ারা ভবনটি ২০০৬ সালে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে হলের প্রকৌশল শাখা। তবুও দীর্ঘদিন ধরে ওই ভবনের অতিথি কক্ষে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী বসবাস করছেন।

সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে শিক্ষার্থীদের চলাচলের করিডোরে বাঁশ দিয়ে ঠেস দেওয়া হয়েছে 

এ ভবনে ১৫টি অতিথি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে তিনতলায় ১১০ জন এবং দোতলায় ২৪ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। বাইরে থেকে সুন্দর করে রঙ করা ভবনটি দেখলে বোঝার উপায় নেই এটি ঝুঁকিপূর্ণ।

এই হলের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা সত্ত্বেও প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থী এলোটমেন্ট দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরই মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে এই হলের শিক্ষার্থীরা কয়েকবার আন্দোলন করেছে এবং স্মারকলিপি প্রদান করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আসলে কেউ ভাবছে কি না আমার জানা নেই। 

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে শিক্ষার্থী অ্যালোটমেন্ট বন্ধ করে দিলেও ঝুঁকি নিয়ে এখনো সেখানে থাকছে অনেক শিক্ষার্থী। অনেকে আবার রয়েছে বারান্দায়। হলের বিভিন্ন রুমের ছাদের পলেস্তারা খসে শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। জানা যায়, হলটি শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে গেলে হলের যে অংশটা এখনো ভালো আছে নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই সেখানে বিভিন্ন গবেষকদের জন্য প্রস্তুত করা হবে।

সম্প্রতি অভিযোগ আসে ঢাবির হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ২৪৪ নম্বর রুমের ছাদ থেকে সিমেন্ট, সুড়কি ভেঙে ভেঙে পড়ছে। শুধু এক রুমই নয় একাধিক রুমে এমন ঘটছে বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ২৪৪ নম্বর রুমের শিক্ষার্থী রাকিবুল আলম বলেন, সকাল ৬টার দিকে হঠাৎ করে পায়ের কাছে ইট-সুড়কির খন্ড ছুটে পড়ে। আমাদের ভাগ্য ভালো কেউ আহত হয়নি। তবে প্রায়শই বিভিন্ন কক্ষে এরকম পলেস্তারা খসে পড়ে। এতে যেকোন সময়  শিক্ষার্থীরা মারাত্মক আহত হতে পারে। 

হল সংস্কারের বিষয়ে মুহসিন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মাসুদুর রহমান জানান, মুহসীন হলের বয়স এখন প্রায় ৫৭ বছর। এজন্য আমাদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এর আগে আমরা উপরের পাঁচ থেকে সাত নম্বর তালায় নতুন করে প্লাস্টার করে রঙ করিয়েছি আবার নিচের ফ্লোর গুলোতে এধরণের সমস্যা হচ্ছে।  

প্রভোস্ট কমিটির মিটিংয়ে আমি আগের উপাচার্য স্যারকে এ বিষয়ে অবহিত করেছিলাম এবং ব্যক্তিগত ভাবেও করেছিলাম। তার আগেই আমি ইঞ্জিয়ারিং বডিকে জানাই তারা এসে কিছু অংশ ঠিক করে দিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমার সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের মিটিং হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক নিয়ম অনুযায়ী বাকি অংশ এবং করিডোরের কিছু জায়গায় সমস্যা আছে সব বিষয় মাথায় রেখে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এছাড়াও শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের করিডোর রয়েছে বেহাল দশায়। এতটা ঝুকিঁপূর্ণ হওয়া স্বত্বেও প্রশাসন বাঁশ দিয়ে ঠেস দিয়েছে।  এছাড়াও পুরাতন ভবনের বিভিন্ন রুম এবং টিনশেডের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের দাবী হল সংস্কার এখন খুবই জরুরী। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, জহুরুল হক হল অনেক পুরাতন হল। অন্যদিকে এই হলে প্রচুর শিক্ষার্থীর অবস্থান। যদি ১৫ ই অক্টোবরের মত কোনো ঘটনা ঘটে তার জন্য কে দায়ী থাকবে। আমার মনে হয় পুরোনো হল গুলোর দ্রুত সংস্কার দরকার। 

ঢাবির সকল শিক্ষার্থীদের সার্বিক  নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা  প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাকসুদুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ভিসি স্যারের সাথে প্রথম দিনেই আমাদের মিটিং হয়েছে এবং সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনিতে তো এসএম হলে তো নতুন শিক্ষার্থী আর দেওয়া হচ্ছে না। যেহেতু হল গুলো নিয়ন্ত্রণ করে প্রভোস্টরা তাই প্রভোস্ট কমিটি এই বিষয়টা ভালো ভাবে দেখে যদিও নতুন উপাচার্য আসার পর প্রভোস্ট কমিটির মিটিং এখনো হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বিভিন্ন সংস্কারের জন্য আমাদের একটা প্রকল্প আছে। টাকা হাতে পেলেই সংস্কারের কাজ শুরু হবে। রসদ না থাকলে তো আর কাজে হাত দেওয়া সম্ভব না। পুরাতন হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণে থাকার কথা তার থেকে বেশি পরিমাণে থাকছে। যেখানে থাকার কথা এক হাজার সেখানে থাকছে দুই হাজার। দ্বিগুন লাইফ লোড এখানে পড়েছে। এসব কারণে ভবনের স্থায়িত্ব কমে যায়। 

তিনি আরও জানান, উপাচার্য হলাম মাত্র এক সপ্তাহ কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা অনেক। টাকা পয়সা কোথায়? আমি সলিমুল্লাহ হলসহ কয়েকটি হলের প্রভোস্টদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। আমাদের বিভিন্ন সংস্কার কাজের জন্য ১১৯ কোটি টাকা বাজেট রয়েছে। টাকা আসলেই সংস্কার কাজ শুরু হবে।

উপাচার্য আরও জানান,  আমি যখন শিক্ষক সমিতিতে ছিলাম, আমরা গিয়ে মৈত্রী হলের মনোয়ারা ভবন ঝুঁকিপুর্ণ ঘোষণা করে আসি। তখন থেকেই ওখানে শিক্ষার্থী থাকা নিষেধ ছিলো। পরে শুনলাম শিক্ষার্থীরা জোর করে সেখানে থাকছেন। এ বিষয়ে যখন আমি পূর্ববর্তী উপাচার্যের কাছে জানতে চাইলাম স্যার জানাইলেন শিক্ষার্থীরা সেখানে জোর করে থাকছে। এসময় তিনি জানান আগামী সপ্তাহে প্রভোস্ট কমিটির মিটিংয়ে আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবো।

১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে প্রশাসনের এমনই উদাসীনতায় জগন্নাথ হলে ঘটে যায় ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। ওইদিন প্রাণ হারান হলের ছাত্র ও কর্মচারীসহ ৩৯জন। তবুও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। প্রতিবছর ঘটা করে কালো কাপড় বুকে সেঁটে দিবসটি স্মরণ করা হলেও এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেছে ঢাবির বেশ কয়েকটি হল। শিক্ষার্থীদের মতে এগুলো খুব তাড়াতাড়ি সংস্কার করা না হলে রচিত হবে আরও কয়েকটি অক্টোবর।


সর্বশেষ সংবাদ