মাস না পেরোতেই ঢাবির হলে দুই ছাত্রের মৃত্যু, নড়েচড়ে বসলো প্রশাসন
হলে হলে সাইকোলজিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ
- জুবায়ের হোসেন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৩১ AM , আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৪৫ PM
মানসিক সমস্যা ও আর্থিক সংকটের জেরে মাস না পেরোতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে দুই ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির আবাসিক হলে এরকম ঘটনার প্রত্যক্ষ করা না গেলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যারা আত্মহত্যা করছেন, তারা বেশিরভাগই মানসিকভাবে বিষন্ন এবং হতাশাগ্রস্ত। তাই প্রতিটি হলে শিক্ষক হিসেবে মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলর পদে একজন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। শিগগির এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।
গত ২১ আগস্ট বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ১৬৫ নম্বর রুমে শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে বিজয় একাত্তর হল থেকে নিচে পড়ে কাজী ফিরোজ নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে। পরে তার একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে
হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রতিটি হলে অন্তত একজন সাইকোলজিস্ট দরকার এবং তাদের নিয়মিত সেশন করা জরুরি। এতে করে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা একটু হলেও স্বস্তি পাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সবগুলো হলে এবং ছেলেদের বিজয় একাত্তর ও অমর একুশে হলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োজিত থাকলেও তাদের কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ে না। শিক্ষার্থীরা বলছে, প্রতিটি হলেই মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ এবং তাদের নিয়মিত কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি।
বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী ফাহিম হোসেন বলেন, হলে যে সাইকোলজিক্যাল মেন্টর আছে, এ বিষয়ে আমি কেন- আমার বন্ধুবান্ধবও জানে না। হলে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম হয়েছে বা কোনো শিক্ষার্থী এ ধরনের কোনো সুবিধা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। কয়েকদিন আগে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করে উপাচার্যের মুখ থেকে জেনেছি যে মেয়েদের হলে সাইকোলজিস্ট থাকলেও দুঃখজনকভাবে ছেলেদের হলে নেই। তিনি এ বিষয়ে অবগত থাকলেও এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মেয়েদের হলেও তাদের কোনো কার্যক্রম আছে বলে শোনা যায় না।
গত ২১ আগস্ট বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ১৬৫ নম্বর রুমে শেখ মঞ্জুরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। এদিকে, গত মঙ্গলবার রাতে বিজয় একাত্তর হল থেকে নিচে পড়ে কাজী ফিরোজ নামে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী সাব্বিরুল হক বলেন, আমাদের ছেলেদের হলগুলোয় কোনো প্রকার সাইকোলজিস্ট আছে বলে জানি না। কিন্তু গত এক মাসে ছেলেদের হলেই দুটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ছেলে এবং মেয়েদের হলগুলোয় অন্তত একজন করে সাইকোলজিস্ট দরকার। আর যেখানে সাইকোলজিস্ট আছে সেখানে তাদের দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম দরকার।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে বেশির ভাগ দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা থাকে। এদের বেশির ভাগেরই আর্থিক সমস্যা থাকে, যার ফলে তারা প্রথম থেকেই হতাশাগ্রস্ত। এছাড়া নানা কারণে বহু শিক্ষার্থীর এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থী যখন এ ধরনের অপমৃত্যু চোখের সামনে দেখে, সে মানসিকভাবে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। যার ফলে তারাও কেউ কেউ এ ধরনের পথ বেছে নেয়। যার প্রমাণ পর পর দুটি আত্মহত্যা।
তিনি বলেন, এ ধরনের অপমৃত্যু প্রকাশ্যে বার বার ঘটতে থাকলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে স্বাভাবিক। তবে আমার মনে হয়, এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দদের সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সাইকোলজিস্ট নিয়োগ ও তাদের নিয়মিত কার্যাবলি নিশ্চিত ও বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করা উচিৎ।
আরো পড়ুন: হল থেকে পড়ে ঢাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু
প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল বাছির বলেন, আমাদের গত প্রভোস্ট কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রত্যেকটা হলে শিক্ষক হিসেবে মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলর পদে একজন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক যারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাদেরকে হাউজ টিউটরের মতো করে নিয়োগ দেওয়া হবে এবং অচিরেই এটি বাস্তবায়ন হবে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রধান সমস্যা হলো আর্থিক। একটা আর্থিক সাপোর্ট তাদের দরকার। এ বিষয়ে আমি আলাপ করেছি যে, কিছু টাকা ছাত্র কল্যানের জন্য রাখা হয় সে টাকা কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তার হিসাব রাখা। কী কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে, সে কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং তারপর একটা ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আমাদের তথ্য দরকার, কতজন ছেলে-মেয়ে এমন মানসিক হতাশার মধ্যে আছে। এ বিষয়ে একটা জরিপ করতে হবে।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক হতাশাগ্রস্ততার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, আগে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। ছেলে-মেয়েরা পাঠচক্র করতো। এগুলো এখন কমে গেছে। এটা একটা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন।
হলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের ব্যাপারে তিনি জানান, এ উদ্যোগটা যত দ্রুত নেওয়া যায়, তত ভালো। কিছু কিছু হলে এখনো সাইকোলজিস্ট আছে। তবে সব জায়গায় দেওয়ার একটা আর্থিক ব্যাপার এখানে রয়েছে। কিন্তু এখন তো করতেই হবে। একটা শিক্ষার্থীকে যখন পড়ার সুযোগ আমরা দিয়েছি, সে যাতে ভালো করে পড়াশোনা করতে পারে সে জন্যে তার যে সহায়তামুলক ব্যবস্থা সেটি তো না করলে হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এম মাকসুদুর রহমান বলেন, আবাসিক হলগুলোতেও একজন করে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেটি শিগগির কার্যকর হবে বলে তিনি জানান।