পুরান ঢাকার যেসব স্থানে একদিনেই ঘুরতে পারেন

বলধা গার্ডেন, বিউটি বোর্ডিং রুপলাল হাউজ, আহসান মঞ্জিল ও বাহাদুর শাহ পার্ক।
বলধা গার্ডেন, বিউটি বোর্ডিং রুপলাল হাউজ, আহসান মঞ্জিল ও বাহাদুর শাহ পার্ক।  © টিডিসি ছবি

কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই বাসায় ফিরতে হবে? তাহলে পুরান ঢাকা হতে পারে আপনার জন্য বেস্ট অপশন। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন পুরান ঢাকার কোন কোন জায়গাগুলোতে ঘুরলে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাসায় ফিরতে পারবেন। প্রিয় মানুষগুলো কিংবা পরিবারের ছোট সদস্যটিকেও সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করতে পারেন এসব স্থাপনায়। জানতে পারবেন ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের কথা, বুঝতে পারবেন বুড়িগঙ্গা নদী কিভাবে প্রভাবিত করতো তৎকালীন মানুষের জনজীবনকে।

১. বলধা গার্ডেন

সকাল সকাল রাজধানীর যেকোনো প্রান্ত থেকে চলে আসবেন গুলিস্তান। সেখান থেকে ওয়ারী। এটি মূলত একটি উদ্ভিদ উদ্যান। এই উদ্যানে রয়েছে অনেক প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ। ১৯০৯ সালে গাজীপুরের বলধার রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধূরী এ গার্ডেনের সূচনা করেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নানারকম ফুলগাছ ও অন্যান্য উদ্ভিদ এনে রোপণ করেছেন নিজের তৈরি এ গার্ডেনে। মূলত বলধা গার্ডেন হচ্ছে ফুল ও উদ্ভিদের একটি মিউজিয়াম। এখানে রয়েছে একটি সূর্যঘড়ি। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এসেছিলেন এই গার্ডেনে তখন তিনি বহু বিদেশি ফুলের বাংলা নামকরণ করেছিলেন। গার্ডেনটিতে প্রবেশের জন্য বড়দের গুণতে হবে মাত্র ৩০ টাকা এবং শিশুদের জন্য প্রবেশমূল্য ফ্রি।

২. বিউটি বোর্ডিং

বলধা গার্ডেন থেকে ঘুরে চলে আসবেন বাংলাবাজার। এবার আপনার গন্তব্য বিউটি বোর্ডিং। বাংলাবাজারের ১নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত একটি দোতলা পুরাতন বাড়ি। এ বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ বাড়িতে। ১৯৪৭ সালে এ বাড়িটি থেকেই কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল।

বিউটি বোর্ডিং এর জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এখানে যারা আড্ডার আসরে আসতেন এদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, গোলাম মুস্তাফা, খালেদ চৌধুরী, সমর দাস, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, ভাষাসৈনিক ও পুস্তক প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান, সিকদার আমিনুর হক, জুয়েল আইচ প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।

বিউটি বোর্ডিংয়ের সামনের আঙ্গিণায় বসে এক কাপ গরম চায়ের ফু দিয়ে স্মরণ করতে পারেন এসব খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের। বিউটি বোর্ডি দেখা শেষে চলে যেতে পারেন রুপলাল হাউজ কিংবা লালকুটির।

৩. রূপলাল হাউজ অথবা নর্থব্রুক-হল অথবা লালকুটির

রুপলাল হাউজ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ফরাশগঞ্জে অবস্থিত। এ হাউজটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে বহন করছে উনিশ শতকের ঐতিহ্য। এ হাউজিটির ছাদ নির্মাণ করা হয়েছিল কোরিনথীয় রীতিতে এবং উপরে রয়েছে অভিনব কায়দায় নির্মিত পেডিমেন্ট। দোতলা এই হাউজটির নকশা প্রণয়নে কাজ করেছিল মার্টিন এন্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতি।

নর্থব্রুক হল স্থানীয়দের কাছে লালকুটি নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। ১৮৭৪ সালের ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থ ঢাকা সফরে এসে একে স্মরণীয় করে রাখতে একটি টাউন হল নির্মাণ করা হয়। ১৯২৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এলে তাকে এই নর্থব্রুক হলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে রয়েছে। খুব দ্রুততম সময়ে এটি সংস্কার করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। 

দেখুন সূর্য যদি এবার মাঝ আকাশে থাকে তাহলে চলে আসুন ইসলামপুর।সেখানে সেরে নিন নবাবী ভোজ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বিরিয়ানি দিয়ে। এবার পড়ন্ত বিকেলে বুড়িগঙ্গার তীরে অবলোকন করুন আহসান মঞ্জিলের অপরূপ সৌন্দর্য্য।

৪. আহসান মঞ্জিল

পুরান ঢাকার ইসলামপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। আহসান মঞ্জিলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামে এ প্রাসাদটির নামকরণ করেন। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এ প্রাসাদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। এ প্রাসাদটির ছাদের উপর একটি গম্বুজের চূড়া ছিল। যা তৎকালীন সময়ে ছিল ঢাকার সবচেয়ে উঁচু চূড়া। কথিত আছে ১৯০৫ সালে ঢাকা শহরে প্রথম বৈদ্যুতিক আলো আসে এই আহসান মঞ্জিলে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি জাদুঘর। প্রতি শনিবার থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘরটি এবং শুক্রবার বিকেল তিনটা থেকে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরটিতে প্রবেশের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ২০ টাকা এবং শিশুদের জন্য ২.০০ টাকা হারে টিকিট ক্রয় করতে হবে।

৫. বাহাদুরশাহ পার্ক

এবার চলে আসুন সদরঘাটের সন্নিকটে বাহাদুরশাহ পার্কে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজরা এ জায়গাটি কিনে নেয়। পরবর্তীতে তারা এটিকে একটি পার্কে রুপ দেয়। পুরান ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ পার্কটি আজও বহন করছে সিপাহি বিদ্রোহের করুন ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহীদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হত এ ময়দানের গাছের ডালে। লোকমুখে শোনা যায় এ পার্কে বাগডাশা, বনবেড়ালসহ অনেক ধরনের পশু দেখা যেত। এ স্থানটি বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।

এবার সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে বাহাদুরশাহ পার্কের মোড় থেকে গন্তব্য অনুযায়ী গাড়িতে উঠে বাড়ির পথ ধরুন।


সর্বশেষ সংবাদ