ওএমআর মেশিনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণসহ ১০ প্রস্তাবনা ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ডাকসু নির্বাচন আয়োজনে

ডাকসু নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে ১০ প্রস্তাবনা জমা ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের
ডাকসু নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে ১০ প্রস্তাবনা জমা ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংকের  © টিডিসি সম্পাদিত

আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ আয়োজন করতে চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবর ১০টি প্রস্তাবনা দিয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক (ইউটিএল)। আজ রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সিনেট ভবনস্থ নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানীর কাছে এই প্রস্তাবনাগুলো দেওয়া হয়। এসময় ইউটিএল-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান বিশ্বাসসহ সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ডাকসু নির্বাচনের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও প্রক্টরের কাছে এসব প্রস্তাবনা দেওয়া হবে সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে দেওয়া এসব প্রস্তাবনায় বলা হয়, এই নির্বাচন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ নির্বাচনকে ঘিরে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দলসমূহ, দেশের মানুষ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ বিদ্যমান। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকারই নিশ্চিত হবে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি, মর্যাদা ও আস্থার ভিত্তি আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইউটিএল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নির্বাচনকে ঘিরে ন্যায়সংগত, প্রযুক্তিনির্ভর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এ নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইউটিএল মনে করে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে এটি করা সম্ভব। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে ১০টি প্রস্তাবনা ও প্রস্তাবনার যৌক্তিকতা নিচে তুলে ধরা হলো-

১. ভুয়া ভোটার ও জাল ভোট রোধ
নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নতুন করে কোনো স্টুডেন্ট আইডি (লাইব্রেরি/সেমিনার কার্ড, হল কার্ড, বিভাগীয় কার্ড) ইস্যু না করা অত্যাবশ্যক। এটি জাল ভোট ও ভুয়া ভোটার প্রতিরোধে সহায়ক হবে। সকল দপ্তর/বিভাগ/হল/লাইব্রেরি/সেমিনারে এই নোটিশ জানিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। ভুয়া ভোটার ধরা পড়লে তার ছাত্রত্ব বাতিল এবং কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা নির্বাচন শুরুর আগেই প্রদান করলে অনিয়ম করার মানসিকতা কমবে। এই নোটিশ জারি করে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। 

২. ওএমআর মেশিনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
ভোট গণনায় ব্যবহৃত ওএমআর মেশিনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন না ওঠে, এজন্য বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে একটি অফিসিয়াল এক্সপার্ট টিম গঠন করা প্রয়োজন। নির্বাচনের দিন সকালে ও ভোট শেষে অডিট ট্রায়াল বাধ্যতামূলক করা উচিত। ট্রায়ালের সময় পর্যবেক্ষক, এজেন্ট ও সাংবাদিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করলে স্বচ্ছতার বিষয়ে সবার আস্থা বাড়বে। ভোট গণনার সময় বড় স্ক্রিনে ফলাফল প্রদর্শন করলে প্রক্রিয়াটি সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত থাকবে।

৩. কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ঘোষণা
প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে ফলাফল ঘোষণা করতে হবে এবং পোলিং এজেন্টদের ফলাফলের কপি প্রদান করতে হবে। এতে ফলাফল নিয়ে বিভ্রান্তি ও সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।

৪. আচরণবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ
নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হওয়ার পর কোনো প্রার্থী কিংবা ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে কর্মসূচি ঘোষণা করা আচরণবিধি লঙ্ঘন। এ বিষয়ে প্রক্টরিয়াল টিমকে সক্রিয় হতে হবে এবং লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে নিয়মিতভাবে সতর্ক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করলে শিক্ষার্থীরা আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য হবে।

৫. নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা
ছাত্রীদের ভোটকেন্দ্রে নারী শিক্ষক ও নারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান করলে নারী ভোটারদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বাড়বে এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। নারী শিক্ষার্থীদের ভোটকেন্দ্র ও এর আশেপাশে নারী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত করতে হবে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি সহজে সামাল দেওয়া যায়। নারী ভোটারদের নিরাপত্তা ও তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য কেন্দ্রভিত্তিক একটি হেল্পডেস্ক বা জরুরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

৬. ক্যাম্পাস নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গেটে পুলিশের চেকপোস্ট স্থাপন করা প্রয়োজন যাতে বহিরাগত প্রবেশ বন্ধ থাকে। আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস এলাকায় বহিরাগতদের উপস্থিতি প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। নির্বাচনের আগের রাত থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো হলে যেকোনো নাশকতার চেষ্টা প্রতিহত করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ক্যাম্পাসের চারদিকে সেনা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স অবস্থান করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।

৭. প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি
ক্যাম্পাস ও ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা সচল আছে কিনা. তা পরীক্ষা ও নিশ্চয়তা দিতে হবে। বডি ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ রেকর্ড করা হলে অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে।

৮. প্রচারণা ও গণআস্থা
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রচারণা চালিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা প্রয়োজন যে, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা নেই। ক্যাম্পাসে ভোটের একদিন আগ থেকে নিরাপত্তা ও মনিটরিং বুথ চালু করলে শিক্ষার্থীরা আস্থা পাবে।

৯. নির্বাচনকালীন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তা কেন্দ্র
ভোটের আগের রাত থেকে নির্বাচন শেষ হয়ে ফলাফল ঘোষণার পর পর্যন্ত একটি কেন্দ্রীয় হেল্পলাইন/কন্ট্রোল রুম চালু থাকতে হবে। সকল কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সাপোর্ট ডেস্ক থাকতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা কিংবা প্রার্থীরা যেকোনো অভিযোগ করতে পারেন। কেন্দ্রীয় মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে এবং সেখানে পর্যাপ্ত ফোন নম্বরের সংযোগ রাখতে হবে। এই নম্বরগুলো সকল পোলিং ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে তারা দ্রুত কেন্দ্রীয় সাপোর্ট ও নির্দেশনা পেতে পারেন। ফোন নম্বরের পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ/টেলিগ্রাম গ্রুপ বা ই-মেইল সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে যাতে দ্রুত রিপোর্ট করা যায়।

প্রতিটি ভোটকেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোটের অগ্রগতি ও পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমে রিপোর্ট করতে হবে। কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রক্টরিয়াল টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হতে হবে। মনিটরিং সেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক, পর্যবেক্ষকগণের প্রতিনিধি এবং পুলিশের একজন সিনিয়র অফিসার সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকবেন। প্রতিটি অভিযোগ বা কল রেকর্ড নথিভুক্ত করতে হবে, যাতে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রগুলো সরাসরি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

১০. ফলাফল প্রকাশ ও পরবর্তী শৃঙ্খলা
প্রতিটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও ওএমআর কাউন্টিং মিলিয়ে দেখা নিশ্চিত করতে হবে। ফলাফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ ও অনুমোদিত কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরসহ ডকুমেন্ট আকারে সরবরাহ করলে অনিশ্চয়তা ও গুজব কমে যাবে। ফলাফল ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি টিচার্স লিংক বলছে, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করবে না, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকে সুসংহত করবে। 


সর্বশেষ সংবাদ