দেশ কার শাসনে, কোন বিধি অনুসারে চলছে—প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০৭:১৫ PM , আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০৭:১৫ PM
বাংলাদেশ বর্তমানে কার শাসনে, কোন বিধি অনুসারে চলছে। সেনাপ্রধানের, নাকি প্রেসিডেন্টের, নাকি স্পিকারের তত্ত্বাবধানে মন্ত্রিসভার অধীনে- উদ্বেগ জানিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক এ কথা জানায়।
এতে আরও বলা হয়, ছাত্ররা অসহযোগের ডাক দিয়েছে। তাহলে তাদেরকে বাদ দিয়ে আইএসপিআর কোন ক্ষমতাবলে সব কিছু খোলার ডাক দিল? বিবৃতিতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক হামলাসহ সব সহিংসতা রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।
এতে বলা, একটি চরম নিপীড়নমূলক ও ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে জুলাই মাসের প্রথম থেকে আপামর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। বৈষম্যের পরিবর্তে সাম্যের দাবি তোলায় তাদের শিকার হতে হয় নির্মম হত্যাকাণ্ডের।
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসকে প্রধান করে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব
‘ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যা এবং শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের গোয়ার্তুমি আর প্রতিশোধপরায়নতা, অব্যাহত হামলার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থী আন্দোলন একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।’
বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষার্থী-নাগরিকদের অবিস্মরণীয় বিদ্রোহের মুখে গতকাল শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ও ভয়াবহ নিপীড়নমূলক স্বৈরশাসন থেকে এই মুক্তি অর্জনের জন্য তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের শিক্ষার্থীসহ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মুক্তিকামী জনতাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
‘তবে আমরা মনে করি, একটি নিপীড়নমূলক ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে এই মুক্তি অর্জন রাষ্ট্রকে মেরামত করে একটি গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী, অসাম্প্রদায়িক, সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকারী রাষ্ট্রে রূপান্তরের কঠিন পথ আমাদের সামনে। মুক্তি এখনও অর্জিত হয়নি।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যেতে চাননি: জয়
বিবৃতিদাতারা বলেন, ১৯ জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সন্ধ্যা থেকে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার শর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে মাঠে মোতায়েন করে। তারপরও পরিস্থিতির ক্রমাবনতি হতে থাকে এবং গত রোববার সারাদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক (অফিসিয়াল হিসাবে ১০২ জনের বেশি) মানুষ নিহত হয়। অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি এবং তিন দিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের এই ঘোষণা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ৫ অগাস্ট ঢাকা মার্চ-এর ডাক দেয়। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী ও নাগরিকের সমাবেশ ও বিদ্রোহের মুখে গতকাল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং বিদেশে পালিয়ে যান।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক জানায়, দুপুরে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে পালানোর পর আমরা দেখতে পাই সেনাবাহিনী প্রধান জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে বলে জানান। এরপর আমরা দেখতে পাই যে, সেনাপ্রধান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এবং বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের সাথে মিটিংয়েও বসেন।
‘কিন্তু এই সংকটময় মুহূর্তে আমরা বিস্মিত হয়ে ঢাকা শহরসহ সারাদেশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতি আর চেইন অব কমান্ডের পুরাপুরি অনুপস্থিতি লক্ষ্য করি। বিভিন্ন অঞ্চলে ও রাজধানীতে মোতায়েন সেনাসদস্যদের নিস্ক্রিয়তা লক্ষ্যণীয়ভাবে আমাদের নজরে পড়ে। বাস্তবে, সেনাপ্রধানকে টেলিভিশনে দেখাচ্ছিল অপ্রস্তুত; যেন এক জাহাজচালক যিনি তার নাবিকদের চেনেন না। কেন? এই কয়দিনের ঘটনাবলীর কোনো পাঠ তাদের ছিল না? কোনো পরিণতি তারা আগাম-আন্দাজ করতে পারেন নাই? এতগুলো গোয়েন্দাসংস্থা তাহলে খামখা আছে? আর যদি কোনো রিডিং থেকে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনার পরিণতির পর কীভাবে শৃঙ্খলা রক্ষা হবে তার একটা আউটলেট তারা তৈরি করেননি কেন?
আরও পড়ুন: কী হয়েছিল শেষ মুহূর্তে, যে পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা
বিবৃতিতে বলা হয়, পরিস্থিতিতে আমাদের এও মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে সেনাবাহিন ডাম্প করেছে।’ওয়ার-ক্যাজুয়ালটির’র মতো তাদেরকে ক্রুদ্ধ জনতার সামনে অরক্ষিত রেখেছে। জানমালের হেফাজতের যে ওয়াদা সেনাপ্রধান করেছেন, তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি যে তাদের নেই তা খুবই স্পষ্ট। আমরা সেনাবাহিনীকে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার আগেই পেশাগত কর্তব্য পালনের আহ্বান জানাই।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অথচ শাসন ও শাসক বদলের ক্রান্তিকালে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা সবসময়ই থাকে। প্রশাসনিক অস্পষ্টতা, শূন্যতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগে দুষ্কৃতিকারীরা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, লুটতরাজ চালানো শুরু করে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর, লুটপাট, থানা জ্বালিয়ে দেয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বরের এবং বিখ্যাত ঐতিহ্য ময়মনসিংহের শশী লজসহ নির্বিচার ভাঙচুর, ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপরে হামলা, তাদের সম্পত্তি লুটপাট ও পোড়ানো শুরু হয়। একইসঙ্গে সন্ধ্যা থেকে খবর আসতে থাকে যে কিছু স্থানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও তাদের বাসাবাড়িতে, ধর্মস্থানের উপর হামলা লুটপাট অব্যাহত আছে। সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে ও মিডিয়া কর্মীদের উপরে হামলা হয়েছে। থানায় থানায় ক্ষিপ্ত জনতা পুলিশের উপর হামলা করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের উপর হামলা করছেন। নৃশংস সব মৃত্যুর খবর আমাদের কাছে নিয়মিত আসছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক জানায়, এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘোরতর আশঙ্কা করছি আমরা। পুলিশের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনী নাগরিকদের সুরক্ষায় এগিয়ে না এলে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের গণঅভ্যুত্থান নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। সাময়িক বিজয় গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে না গিয়ে, একটি পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুবিধাবাদী, মতলববাজ, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শক্তির কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা আবার কুক্ষিগত হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: পুলিশ নেই ঢাকার ‘বেশিরভাগ’ থানায়
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা চাই অতি দ্রুত একটি সুস্থ সভ্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশে চালু হবে। আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাস একযোগে রুখে দিতেও আমরা বদ্ধপরিকর। পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রাখা হবে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম লক্ষ্য। তাই ছাত্র-জনতার এই অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানকে কেউ কালিমালিপ্ত করতে না পারে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। উল্লাস-উচ্ছ্বাস যাতে কোনোরকম প্রতিহিংসার জন্ম না দেয় সেদিকে দায়িত্বশীল নাগরিকদের সজাগ থাকতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে নিম্নোক্ত বিষয় বা ঘটনাবলী সম্পর্কে উদ্বেগ পেশ করছি।
১। বাংলাদেশ বর্তমানে কার শাসনে কোন বিধি অনুসারে চলছে? সেনাপ্রধানের, নাকি প্রেসিডেন্টের, নাকি স্পিকারের তত্ত্বাবধানে মন্ত্রিসভার অধীনে? ছাত্ররা অসহযোগের ডাক দিয়েছে। তাহলে তাদেরকে বাদ দিয়ে আইএসপিআর কোন ক্ষমতাবলে সকল কিছু খোলার ডাক দিল?
২। গণভবন, বিভিন পুলিশ থানা সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা সুরক্ষায় পুলিশের উপস্থিতি নেই কেন? পুলিশের অবর্তমানে সেনাবাহিনী সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলো কেন?
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা: গণতন্ত্রের আইকন যেভাবে একনায়ক
৩। কোন আইনের বলে এবং কোন কোন মানদণ্ডের আলোকে রাজনৈতিক নেতাদের বঙ্গভবনে সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে দেখা করার জন্য মনোনীত বা নির্বাচিত করা হলো?
৪। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সুরক্ষা প্রদানে এবং চলমান সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে কোন ধরনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না কেন? এমন পদক্ষেপ এখন কে নিবে- রাষ্ট্রপতি নাকি সেনাবাহিনী?
৫। সেনাবাহিনীর কাজ হলো গণঅভ্যুত্থানকে নিরাপত্তা প্রদান করা এবং গণ অভ্যুত্থানকারীদের এখনকার কাজ হলো বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। এটা নিয়ে আলাপ না করে সেনাবাহিনী কর্তৃক বা সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার সংক্রান্ত আলাপ জনপরিসরে উঠছে কেনো? কারা এই ধরনের আলাপ তুলছে?
আরও পড়ুন: ভারত থেকে কোথায় যাবেন শেখ হাসিনা?
৬। সর্বোপরি, গণঅভ্যুত্থান সফল করা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রমজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণি, সিভিল প্রশাসন, এবং মিলিটারি প্রশাসনের সমন্বিত আলাপ ও আলোচনা না শুরু না করে বঙ্গভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ করার মাধ্যমে জনগণকে কী বার্তা দেয়া হচ্ছে?'
অতি দ্রুত দেশের জনগণের সুরক্ষা এবং সহিংসতা বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে এবং অবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে এর পরবর্তীতে একটি সংবিধান সভা গঠিত করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে এর আলোকে একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।