আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার, বাবা চিৎকার করে সবাইকে বলছিলেন
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৩০ PM , আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৩৭ PM
দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ফকিরাঘোনা। শিক্ষার আলো ও সচেতনতার দিক দিয়ে অন্যান্য গ্রামের চেয়ে অনেক পিছিয়ে এলাকাটি। স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সে গ্রামেরই ছেলে সালাহ্ উদ্দিন কাদের। বাবা সৈয়দ আহমদ ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। যৌবনে রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। এলাকায় সন্ধ্যাকালীন বয়স্ক শিক্ষার পাঠদান করতেন বলে সবাই তাঁকে সৈয়দ মাস্টার বলে ডাকেন।
বাবা পরবর্তীতে পান ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তবে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। অনেক টানাপড়েনের সংসার ছিল সালাহ্ উদ্দিনের। এ পরিবার থেকে অনেক সংগ্রাম করে উঠে এসে বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেন তিনি। ৪৩তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি ৪৪তম বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। ৪৫তম বিসিএসের প্রিলি উত্তীর্ণ হয়েছি। সম্প্রতি আইসিবির সিনিয়র অফিসার পদেও সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ সাফল্যের পেছনের গল্প দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন তিনি।
সালাহ্ উদ্দিনের পড়াশোনার হাতেখড়ি মা কুলসুমা বেগমের হাত ধরেই। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন হাফেজ। চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। অন্যজন ওমান প্রবাসী। বোনদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। অন্য দুজনের মধ্যে একজন ভর্তি পরীক্ষার্থী। আরেকজন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে।
মায়ের সচেতনতাই সব ভাই-বোনকে শিক্ষিত পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার মা ছিলেন আমার প্রধান মেন্টর। তিনি অভাবের সংসারে সব সময়ই চাইতেন আমার পড়াশোনায় যেন কোন ব্যাঘাত না ঘটে। যেখানে আমার চাচাতো ভাই-বোনরা কেউই পড়ালেখা করতো না, মাছ ধরতে যেতো, মাটি কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো, পানের বরজে চাষাবাদ করতো, সেখানে আমি ছিলাম ব্যতিক্রম।’
তার ভাষ্য, ‘মা আমাকে নিয়ে খুবই সচেতন ছিলেন। নিজে খুব একটা লিখতে-পড়তে জানতেন না। কিন্তু তিনি আমাকে চক-স্লেট নিয়ে প্রতিদিন নিয়ম করে লেখা শেখাতেন। অ আ ক খ পড়াতেন।’
১৯৯৮ সালে বাড়ির পাশে কেজি স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু সালাহউদ্দিনের। পাশের গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও তার মা ২০০০ সালে তাকে ভর্তি করান তৎকালীন মাসিক ৫০ টাকা বেতনের কেজি স্কুলে। অভাবের সংসারে মা অনেক কষ্টে বেতন জোগাড় করে রাখতেন। তবে বেশিদিন বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। প্রথম শ্রেণি থেকেই ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসেবে কৃতিত্বের সঙ্গে বিভিন্ন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিয়মিত বৃত্তি পেতেন। তাই বেতন মওকুফ করা হয়েছিল।
স্কুলের ৪৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। ফলে পুরো মহেশখালীজুড়ে সালাহউদ্দিনের নাম ছড়িয়ে পড়ে। নবম শ্রেণিতে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলে বড় মামা সালাহ্ উদ্দিনকে মামাবাড়ি নিয়ে যান। সেখানকার বানিয়াকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে প্রথম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। সে সময় বড় মামার বন্ধু মাস্টার সিরাজুদ্দৌলার বাড়িতে পড়তে যেতেন। তিনি কখনো বেতন নেননি। পরে হোয়ানক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। বৃত্তি পাওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিয়াউর রহমান বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ দেন।
বিনিময়ে তিনি চেয়েছিলেন, অষ্টম শ্রেণিতেও তাকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেতে দেখতে চেয়েছিলেন। পরে স্কুলের ৪৭ বছরের ইতিহাসে প্রথম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। ফলে পুরো মহেশখালীজুড়ে সালাহ্ উদ্দিনের নাম ছড়িয়ে পড়ে। নবম শ্রেণিতে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের জোরাজুরিতে তিনি সেখানে ভর্তি না হয়ে আগের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন। জিপিএ ছিল ৪.৯৪।
পরবর্তীতে কক্সবাজার সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। শুরুর দিকে মামার বাসায় এবং পরে মেসে বা লজিং থেকে টিউশন করে পড়াশোনা চালিয়েছেন। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান সালাহ্ উদ্দিন। পরে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে চট্টগ্রামে যান। সেখানে ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হন। কোচিং থেকে সেজ মামার বন্ধু হামিদের কালুরঘাটের বাসার দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তার ওপর মামা চাকরি করতেন। পুরো বাসায় বেশিরভাগ সময়ই একা থাকতেন তিনি। সে সময়টা ছিল খুবই বিষণ্ণতার।
সালাহ্ উদ্দিন বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস কেলেংকারি ও আমার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি না থাকায় মেডিকেলে চান্স পাইনি। প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়ি। টাকার অভাবে ঢাবি, চবি ছাড়া আর কোথাও ফর্ম তুলতে পারিনি। ঢাবির ক-ইউনিটে ৫ হাজার ২৮ তম হয়ে ওয়েটিং লিস্টে থেকে যাই। চবিতে এ ইউনিটে ১ হাজার ১৮৭তম স্থান অধিকার করলেও ভেবেছিলাম চান্স হবে না। তাই হতাশ হয়ে গ্রামে চলে আসি।’
মাস খানেক পর শহরে ফিরে গিয়ে সালাহ্ উদ্দিন জানতে পারেন ওয়েটিং লিস্ট থেকে ২ হাজার ২০০ রোল পর্যন্ত বিষয় পেয়েছে। এদিকে তিনি বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় সবাইকে বলেন, রসায়ন বিষয় পেয়েছেন। ভর্তি হতে ১০ হাজার টাকা দরকার। মা, বড় মামা, সেজ মামা মিলে সে টাকাটা জোগাড় করে দেন। পরে সে টাকা দিয়ে চান্দগাঁওয়ে একটি ব্যাচেলর বাসায় উঠে পুনরায় কোচিংয়ে ভর্তি হন। তিনটি টিউশনি করে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
পরে চবির ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগে ভর্তি হতে সক্ষম হন। এরপর থেকে টিউশনি করে নিজের ও ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে থাকতেই ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে একজনের সঙ্গে পরিচয়। সেখান থেকে পরিচয় থেকে প্রেম। সাত বছরের বেশি সময় ধরে প্রেমের পরিণতি হিসেবে গত ২২ ডিসেম্বর দু’পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেছেন।
আরো পড়ুন: বিভাগে প্রথম হয়েও শিক্ষক হতে না পারা নূশরাত হচ্ছেন বিসিএস ক্যাডার
চট্টগ্রামের একটি কনভেনশন সেন্টারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। ৪৩তম বিসিএসের ফল প্রকাশের দিন এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে খাওয়া-দাওয়া শেষে ঢাকা থেকে বন্ধু শ্রাবণ হঠাৎ করে জানান, ‘বন্ধু, তোর রোলটা পুলিশ ক্যাডারে দেখতে পাচ্ছি। তুই তো ছক্কা মেরে দিয়েছিস!’
সালাহ্ উদ্দিন বলেন, আমি প্রথমে ভেবেছি সে মজা করছে। পরে আমার রোল সে জানে কিনা, জানতে চাই। বললে হুবহু মিলে গেল। আমি তৎক্ষণাৎ ফোনের লাইন কেটে দিয়ে পিএসসির ওয়েবসাইটে ঢুকি। সেখান থেকে পিডিএফ ডাউনলোড করে রোল নম্বর সার্চ করেই লাল রঙয়ের হাইলাইটেড হয়ে ভেসে উঠে। দেখলাম সত্যিই পুলিশ ক্যাডারে ৫১তম হয়েছি। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পাশে আমার বন্ধু ছিল। তাকে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আজ স্বপ্নপূরণ হলো। আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে।’
এরপর দ্রুত বাড়িতে ফোন করে মা, ভাই-বোনকে ফলের কথা জানালাম। সবাই এ খবর শুনে খুশি। বাবা ধান ক্ষেতে ছিলেন। ফোনে ফলাফল শুনে চিৎকার করে সবাইকে বলছিলেন, আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। আজ থেকে আমি এএসপির বাবা। আমার আর কোন দুঃখ নেই।’