নালন্দা কি বিহার না বিশ্ববিদ্যালয়?

  © সংগৃহীত

বিহার কি? এককথায় তীর্থস্থান। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের অর্থ উচ্চশিক্ষার্থে ও গবেষণার জন্য একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। সাধারণ বিহার বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত ভিক্ষুদের বাসস্থান, ধর্মীয় আচারাদি সম্পন্ন ও ধ্যান করার স্থান এবং বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রকে বোঝায়। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুদের জন্য পাঁচ ধরণের আবাসনের (পঞ্চ লেনাণী) মধ্যে বিহার অন্যতম, যা আধুনিক যুগেও টিকে আছে।

লিপিতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র থেকে জানা যায় যে, পাঁচ থেকে বারো শতকের প্রাচীন ভারতে বাংলা ও বিহার প্রদেশের অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ বৌদ্ধ মঠের ও বিহারের অস্তিত্বের জানান দেয়। এরমধ্যে অন্যতম নালন্দা বিহার, সোমপুর বিহার, মহাস্থানগড় ইত্যাদি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে নালন্দা আসলেই কি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। না, তা শুধুই একটি বিহার। এর উত্তর একটু জটিল হলেও তা সহজেই বোধগম্য। বিহারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নালন্দার অস্তিত্ব নিঃসন্দেহ একটি মহাবিহারের সাক্ষী বহন করে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেওয়া সকল শর্তাবলী নালন্দা বিহার ধারণ করতে পারেনি। যার কারনে নালন্দা বিহারের প্রায় ছয়শো বছর পরে ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইতালির ইউনিভার্সিটি অফ বলোগনাকে এখনো বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মূলত নালন্দা বিহার হিসেবে বিকশিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটগণের এবং পরবর্তীকালে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়।

প্রথম দিকে ভিক্ষুরা জ্ঞান অন্বেষণ ও ধ্যান করার মুখ্য উদ্দেশ্য নিয়েই নালন্দায় গমন করত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান অন্বেষণেই সীমাবদ্ধ নয়- চর্চা, বিকাশ, অর্জন, বিতরণ এবং উচ্চ পর্যায়ের গবেষনা এর সাথে সংশ্লিষ্ট। অবশ্য নালন্দাও ধীরে ধীরে জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। যেখানে পরবর্তীতে জ্ঞান চর্চা, বিকাশ অর্জন, বিতরণ শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। হিউয়েন সাং ও ইৎ সিং প্রমুখ পূর্ব এশীয় তীর্থযাত্রী ভিক্ষুদের ভ্রমণ-বিবরণী থেকে এটা প্রমাণিত, নালন্দার অনেক বিখ্যাত পণ্ডিত ও তার শিষ্যদের জ্ঞানচর্চার প্রয়াস স্থানটিকে এক বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দার করাতে সমর্থ হয়েছিল। আজকের যুগে আমরা যেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলে থাকি।

ঐতিহাসিকদের করা বিভিন্ন মন্তব্য থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নালন্দা কেবল বিহারের কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না পরবর্তীতে তা একটি বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়।

নালন্দা বিহার

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে নালন্দা একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। যা প্রাচীন মগধের রাজধানী রাজগৃহের (অধুনা রাজগির) পথে যে বাণিজ্যপথটি ছিল সেই পথের ধারেই নালন্দা অবস্থিত ছিল। নালন্দা মহাবিহার সাত শতকে প্রসিদ্ধি অর্জনকারী বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। বিহারের পাটনা থেকেই ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং আধুনিক রাজগিরের ১১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বড়গাঁও গ্রামের কাছে নালন্দার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ১৪টি চতুর্মাস নালন্দায় অবস্থান করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধও নালন্দার নিকটবর্তী পাবরিক নামক আম্রবনে উপদেশ দান করতেন। বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্যের অন্যতম সারিপুত্র নালন্দাতেই জন্মগ্রহণ এবং নির্বাণ লাভ করেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় সারিপুত্তের চৈত্যের স্থানে একটি বৃহৎ মন্দির নির্মাণ করান। মহাযান দার্শনিক নাগার্জুন ও তাঁর শিষ্য আর্যদেব ছিলেন নালন্দার ব্যক্তিত্ব। নাগার্জুন নালন্দার অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা পর্যটক ফাহিয়েন ভারতে এসে সারিপুত্তের পরিনির্বাণ স্থল ‘নালো’ পরিদর্শন করেছিলেন।

নালন্দা’ শব্দটির উৎস নিয়ে হিউয়েন সাং কয়েকটি মতামত দিয়েছেন। নালন্দা একটি সংস্কৃত শব্দ। ‘নালাম’ শব্দের অর্থ ‘পদ্ম’(জ্ঞানের প্রতীক) এবং ‘দাঁ’ শব্দের অর্থ ‘প্রদান করা’। সে হিসেবে, ‘নালন্দা’ শব্দের অর্থ হয় ‘জ্ঞান প্রদানকারী’। আবার তিনি বলেন, ‘নাগা’(ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সর্প) থেকেও নালন্দা শব্দের আবির্ভাব হতে পারে।' অনুমান করা হয়, খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত এটি শুধুই ধর্মীয় কার্যে ব্যবহৃত হয়। এরপরে ধীরে ধীরে নালন্দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে ছোট ছোট বিহার, চৈত্য, স্তূপ ইত্যাদি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এসকল স্থাপনার সমন্বয়ে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল জগৎ বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাচীন নালন্দায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধার জন্য তিনতলা বিশিষ্ট ভবন ছিল। হিউয়েন সাংয়ের সময়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো এবং শিক্ষকের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৫১০ জন। অর্থাৎ ছাত্র এবং শিক্ষকের অনুপাত ছিল ৭:১। মানে প্রতি ৭ জন শিক্ষার্থীর দেখভাল করার জন্য একজন শিক্ষক ছিলেন। সুব্যবস্থা এবং পড়ার পরিবেশ হিসেবে বর্তমানের যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়কে হার মানায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

নালন্দার সকল ছাত্রই মহাযান এবং বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি (হীনযান) সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতেন। সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, ভেষজবিদ্যা ও সাংখ্য দর্শনও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত ছিল। এছাড়া সাধারণ জ্ঞানের নানা বিষয়ও ছিল। এ পাঠ্যক্রমের অনুসারী ছাত্ররা নিয়মানুবর্তীতা, শিষ্টাচার, গভীর পাণ্ডিত্য ও আদর্শগত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা দেশ বিদেশে যথেষ্ট সুনাম ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে, এখানে ‘ধর্মগঞ্জ’ নামে একটি বিরাট পাঠাগার ছিল। পাঠাগারে ছিল মূল্যবান অনেক পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ।

হিউয়েং সাংয়ের দেয়া তথ্য মতে, ছাত্রদের প্রতিদিন ১০০টি লেকচার দেয়া হতো বিভিন্ন বিষয়ের উপর। উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও ছিল পাঠ্যসূচীর অন্তর্গত। বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য দুটি পরিষদ ছিল। এক পরিষদের কাজ ছিল শিক্ষার দেখভাল করা, আর আরেক পরিষদের কাজ ছিল অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ের তদারকি করা। এসময় শিক্ষালাভের উপযুক্ত স্থান হিসেবে সর্বত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়ে।

জাপান, চীন, পার্সিয়া, তিব্বত, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং তুর্কি রাজ্য থেকেও পণ্ডিত এবং বিদ্বান ব্যক্তিরা আসতেন শিক্ষালাভের জন্য। নালন্দা যখন ক্ষমতা ও খ্যাতির শীর্ষে তখন কোরিয়া ও জাপানেও সবাই নালন্দার নাম জানত। নাগার্জুন, দ্বিতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত মহায়ানা দার্শনিক এ বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষালাভ করেন এবং পরবর্তীতে এখানেই শিক্ষাদানের দায়িত্ব পান।

জৈন ধর্মের প্রচারক মাহাভিরা ১৪ বছর জৈনধর্ম সম্পর্কে শিক্ষাদান করেন। তাঁদের শিষ্য আরাদেভা এবং গৌতম বুদ্ধও এইখানে শিক্ষালাভ করেন এবং ধর্ম প্রচার করেন। গৌতম বুদ্ধের শিষ্য, সারিপুত্রাও এখানে বিদ্যালাভ করেন। পরবর্তীতে নির্বাণ লাভ করে এখানেই ধর্মশিক্ষা দেন। উল্লেখ্য, সম্রাট অশোক তাঁর শাসনামলে বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য সারিপুত্রার স্মরণে একটি মন্দির নির্মাণ করেন।

যদিও বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো, কিন্তু সবাইকেই মৌখিক ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আসতে হতো। মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্বে থাকতেন একজন শিক্ষক, তাঁর পদবী ছিল ‘দ্বার পণ্ডিত’। মাত্র ২০-৩০% ছাত্রকে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়া হতো। কিন্তু এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছিল সম্পূর্ণ রাজকোষের। ছাত্ররা বিনা বেতনে অধ্যায়ন করতো। সম্পূর্ণ খরচ চালানো হতো রাজকোষাগার থেকে দেয়া অর্থ এবং গ্রামবাসীর দেয়া চাঁদা দিয়ে।

চীনা ভিক্ষু জুয়ানজাং তাঁর স্মৃতিকথায় নালন্দার বিবরণ দিয়েছেন। সপ্তম শতকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জুয়ানজাং। তাঁর ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পদদের কোনো ঘাটতি ছিল না। পাঠাগারটি ছিল নয়তলা উঁচু। দিন দিন সেটির উচ্চতা বাড়ছিল, যেন একসময় সেটি আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। জুয়ানজাং যখন নালন্দায় ছিল, তখন সেটি ছিল লোকে পূর্ণ। হাজারও পণ্ডিত প্রতিদিন সেমিনার করতেন, পাঠদান করতেন আর বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক করতেন। সেটি ছিল একরকম বৌদ্ধদের আইভি লিগ। বৌদ্ধমতের সব গভীর চেতনা নালন্দায় চর্চিত হতো ও এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত।

নালন্দার নির্মম পতন

বারো শতকের দিকে নালন্দা তার গুরুত্ব হারায়। তেরো শতকের প্রথমদিকে যখন ধর্মস্বামী নালন্দা পরিদর্শন করেন ততোদিনে এর অতীত গৌরব লুপ্ত এবং এর অনেকগুলি স্থাপনা তুর্কীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কেবল দুটি বিহার ছিল ব্যবহারের উপযোগী এবং সেখানে রাহুলশ্রীভদ্র নামক ৯০ বছর বয়স্ক একজন মহাপন্ডিত-এর সঙ্গে ধর্মস্বামীর দেখা হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১১৯৩ সালে সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে তুর্কি বাহিনী যখন বাংলা, বিহার আক্রমন করে তখন নালন্দ মহাবিহারের নির্মম পতন ঘটে। এই ঘটনাটি ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়।

পারস্যের ঐতিহাসিক মিনহাজ তার তাবাকাতে নাসিরি গ্রন্থে লিখেছেন যে, নালন্দায় হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় কিংবা মাথা কেটে ফেলা হয়। এছাড়াও মহাবিহারের ধর্মগঞ্জ নামে যে বহুতল গ্রন্থাগারটি ছিল, সেখানে প্রাচীন ভারতের সকল জ্ঞানের উৎস ছিল। যেটিকে মাসের পর মাস ধরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কী সেনাবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নালন্দা ছিল এশিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বিখ্যাত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র – সুদূর চীন, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া থেকেও ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতেন।

নালন্দার পুনর্যাত্রা

আটশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নালন্দার একটি খন্ডহর যুগ অতিবাহিত হয়েছে যার সম্পর্কে তামাম দুনিয়া বেখবর ছিল। ১৯শ’ শতাব্দীতে থেকেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এখানে একটি বিহারের অনুসন্ধানে তৎপরতা শুরু করেন। ১৯১৫-১৬ থেকে ১৯৩৫-৩৬ সালের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং জে.এ পেইজ এর নেতৃত্বে এখানে নিয়মমাফিক খননকার্য শুরু হয় এবং ১২ হেক্টর জমিতে সুবিন্যস্ত এগারোটি মঠ ও ইঁটের তৈরি ছয়টি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে প্রচুর ভাস্কর্য, মুদ্রা, সিলমোহর, উৎকীর্ণ লিপি আবিষ্কৃত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিহার সরকার প্রাচীন মহাবিহারটির অনুকরণে পালি ও বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে নব নালন্দা মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৬ ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের সুপারিশে এটিকে পরিগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর চার বছর পরে ২০১০ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিল। যেখানে নতুন আকারে ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, পররাষ্ট্রনীতি, পরিবেশবিদ্যা বা বৌদ্ধ দর্শনের মতো কয়েকটি নির্বাচিত বিষয়ের ওপরে একটি গবেষনাধর্মী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যেগ নেওয়া হয়। এরজন্য দেশ-বিদেশের পন্ডিতদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘নালন্দা মেন্টর গ্রুপ’ -যার নেতৃত্বে ছিলেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

মাত্র ২৫ জনে শুরু আধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় 

পুরনো ধ্বংসাবশেষ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রাজগির এলাকায় নতুন স্নাতকোত্তর বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হচ্ছে। শুরুতে অস্থায়ী ভবনে পাঠদান শুরু হচ্ছে। বৌদ্ধনীতি অনুসরনে এর নিজস্ব ভবনগুলো নির্মাণের কাজ চলছে। সারা বিশ্ব থেকে হাজারেরও বেশি চাহিদা থাকা সত্তেও মাত্র পনেরোজন শিক্ষার্থী আর জনাদশেক শিক্ষককে নিয়েই যাত্রা শুরু করেছে অধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়।

নালন্দার নতুন উপাচার্য গোপা সাবরওয়াল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আসলে একটা শিক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ধরণটাই আলাদা হয়। প্রথম ধরণের প্রতিষ্ঠানে ছাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে, তাদের প্রধান কাজ হল পড়ানো ও মান যাচাই করা, পরীক্ষা নেওয়া। কিন্তু নালন্দা একটা গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটাই সম্পূর্ণ আলাদা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অমর্ত্য সেন নালন্দার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে বলেন, যদি সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তবে ৮০০ বছর পর নালন্দার সুখ্যাতি আবার ছড়াবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গবেষণা প্রস্তাব চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় ইতিহাস এবং বাস্তুবিদ্যা ও পরিবেশ—এ দুটি বিষয়ে পাঠদান শুরু হচ্ছে। 

নালন্দার সাথে বাংলার সম্পর্ক

নালন্দার পন্ডিতগণ ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত। হিউয়েন-সাং এবং ইৎসিং উভয়েই নালন্দার শিক্ষকগণের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। হিউয়েন-সাং যখন নালন্দায় ছিলেন তখন বাঙালি বৌদ্ধ ভিক্ষু শীলভদ্র ছিলেন এর অধ্যক্ষ। শীলভদ্র ছিলেন সর্বপ্রথম বাঙালি বৌদ্ধ শিক্ষক, যিনি বাংলার বাইরে এরূপ দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন। হিউয়েন-সাং নিজেও শীলভদ্রের একজন ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও বাংলার শান্তরক্ষিত ও অতীশ দীপঙ্করও একসময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন।

পরবর্তী পাল রাজাদের দলিলপত্রেও বিভিন্ন প্রসঙ্গে নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায়। পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এলাকায় অবস্থানের কারণে বাংলার সঙ্গে নালন্দার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ। এটি কম গৌরবের বিষয় নয় যে, প্রাচীন যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র নালন্দার উপর বাংলার প্রভাববলয় বিস্তৃত হয়েছিল। একইসঙ্গে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলার সংস্কৃতি ও শিক্ষা এ কেন্দ্র থেকে লাভবান হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ