জাকসু নির্বাচনে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ১২ অভিযোগ
- জাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৯ PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল নির্বাচনে অব্যবস্থাপনা অনিয়ম ও জালভোটসহ মোট ১২টি অভিযোগ তুলেছে।
জাকসু পরবর্তী আজ বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বেলা তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার শিক্ষক লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন ছাত্রদল মনোনীত সহসভাপতি (ভিপি) শেখ সাদী হাসান।
তাদের অভিযোগ গুলো হলো স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সরবরাহ ও অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করা, নির্দিষ্ট দলের পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যালট ছাপানো ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো। ছাত্রদলের প্রার্থী ও সাংবাদিকদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া। পোলিং অফিসারগণ কর্তৃক বিধিবহির্ভূত আচরণ ও কার্যক্রম পরিচলনা করেছেন। বহিরাগত জামায়াত কর্মীদের ক্যাম্পাসের চতুর্তল অবস্থান, নির্দিষ্ট সময় পরেও ভোট গ্রহণ।
৫ আগস্ট-পরবর্তী দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চা যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল সেটার অকাল মৃত্য ঘটেছে বলে বক্তব্যে বলা হয়।
জাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদল প্যানেলের উত্থাপিত অভিযোগগুলো তুলে ধরা হলো।
‘তুলনামূলক স্বল্পসংখ্যক ভোটারের একটি নির্বাচনেও ছবিসহ ভোটার তালিকা সরবরাহ না করা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সরবরাহ না করা, ভোট প্রদানের পর অমোচনীয় কালির ব্যবস্থা না করার মাধ্যমে নির্বাচনকে অবিশ্বাসযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। হল সংসদের ব্যালট পেপারে ক্রমিক নম্বর ও মুড়ি থাকলেও বিস্ময়করভাবে কেন্দ্রীয় সংসদের ব্যালটে এগুলো ছিল না। অমোচনীয় কালি ও ছবিসহ ভোটার তালিকার ব্যবস্থা না থাকায় জাল ভোটের সুযোগ ছিল অবারিত।’
আরও পড়ুন: মরা ও পচা মুরগির মাংস বিক্রির দায়ে ঢাবিতে দোকানিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা
‘ব্যালট বাক্স কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল নির্বাচনের আগের রাতে। অথচ এগুলো নির্বাচনের দিন সকালেই পাঠানো যেতো। কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের সংখ্যার চাইতে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার প্রেরণ করা হয়। পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ছাড়া ব্যালট বাক্স পাঠিয়ে ব্যালট বাক্স লুটের উদ্দেশ্যমূলক গুজব ছড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।’
‘একটি নির্দিষ্ট দলের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির অখ্যাত কোম্পানি এইচআর সফট বিডি এর কাছ থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনা হয়। নির্বাচনে অতিরিক্ত ৩০০০ হাজার ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আমরা মনে করি কোন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ব্যালট পেপার না ছাপিয়ে বিজিপ্রেস বা সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ছাপালে এই অবিশ্বাস ও বিতর্ক এড়ানোর সুযোগ ছিল।’
‘ফজিলাতুন্নেছা হল, জাহানারা ইমাম হল, তাজউদ্দিন হলসহ কয়েকটি হলে জালভোট প্রদানের অভিযোগ ওঠে। জাহানারা ইমাম হলে বুথের মাঝে দুটি প্যানেলের (জিতু-শিবির) লিফলেট সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। ফজিলাতুন্নেছা হলে ব্যালট পেপার ফ্লোরে পড়ে ছিল। এই হলের প্রভোস্ট খুবই আগ্রাসীভাবে একটি প্যানেলের পক্ষে ভোট কারচুপিতে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ইতোপূর্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজেই একটি প্যানেলের পক্ষে ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন। কারচুপির অভিযোগে এই হলে অনেকটা সময় ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। ছাত্রদলের প্রার্থীদের এমনকি নারী সাংবাদিকদের পর্যন্ত তিনি ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন।’
‘অধিকাংশ পোলিং অফিসারগণ নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ব্রিফ করা হয়নি। এর ফলে তারা অনেক ক্ষেত্রেই বিধিবহির্ভূত আচরণ ও কার্যক্রম পরিচলনা করেছেন।’
‘প্রার্থীদের এজেন্টের বিষয়ে নানান টালবাহানা করা হয়। প্রথমে বলা হয় কোন এজেন্ট রাখা হবে না। পরে নির্বাচনের আগের গভীর রাতে এজেন্ট রাখার সিদ্ধান্ত দেয়া হলেও সকালে তাদের কেন্দ্রে ঢোকা নিয়ে হয়রানি করা হয়। প্রথম প্রায় দুই ঘন্টায় হলগুলোতে এজেন্ট ছিল না। একটি নির্দিষ্ট প্যানেলের এজেন্টরা এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায়।’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রফিক জব্বার হলে মোট ভোট প্রদান করা হয়েছে ৪৭০টি। কিন্তু ডাইনিং ও ক্যান্টিন বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিজন প্রার্থীর ভোটের যে সংখ্যা ঘোষণা করা হয়, তার যোগফল ছিল ৫১৩টি। এই অতিরিক্ত ভোটার কোথা থেকে এলো কেউ জানে না। সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেল থেকে নীলা অং মারমা নির্বাচন করেছিলেন। মওলানা ভাসানী হলে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয় শূন্য। এই বিষয়ে একজন ভোটার তার ফেসবুক পোস্টে বলেন যে, মওলানা ভাসানী হলে অনেক আদিবাসী ভোটার থাকে। নীলার অনেক কাছের বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়রেরা আছে। তারা একজনও কি নীলাকে ভোট দেয়নি? কেউ যদি নাও দিয়ে থাকে, তিনি নিজে নীলাকে ভোট দিয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, তার সেই ভোটের হিসাব কোথায়।’
‘কোথাও কোথাও ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নামই ছিল না। সেখানে পছন্দের প্রার্থীর নাম হাতে লিখে জমা দিতে বলা হয়। যেখানে ভোট দিতে হবে ৩ জনকে, সেখানে ১ জন প্রার্থীর নামের পাশে টিক (খ) চিহ্ন দিতে বলা হয়। কিছু কেন্দ্রে কয়েকজন ভোটার এ্যাপ্লিকেশন নিয়ে আসেন যে ভুলক্রমে ভোটার লিস্টে তাদের নাম আসেনাই, তাদেরকে যেন ভোট দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। বিস্ময়করভাবে এখানে প্রভোস্টরা তাৎক্ষণিকভাবে সিল দিয়ে তাদেরকে ভোটার বানিয়ে ভোট প্রদানের অনুমতিও দিয়েছেন।’
আরও পড়ুন: জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, দেখুন এখানে
‘ভোটের আগেরদিন রাত থেকেই সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহিরাগত নেতাকর্মীদের নিয়ে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে চারদিক থেকে অনেকটা অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিশমাইল, গেরুয়া, প্রান্তিক, ইসলামনগর, ডেইরি গেটসহ প্রতিটি জায়গায় ছিল বহিরাগত ক্যাডারদের ব্যাপক উপস্থিতি। তারা অনেকে ক্যাম্পাসের ভেতরেও প্রবেশ করে, বটতলায় খাবার খায়। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। প্রতিটি প্রবেশপথে তারা সংঘবদ্ধভাবে পাহারা বসায়। গভীর রাতে ডেইরি গেটে এসেছিলেন ঢাকা-১৯ আসনে জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী মাওলানা আফজাল হোসাইন। দৃশ্যমান অবস্থান সত্ত্বেও এ বিষয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকার সাংবাদিক জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, 'বিষয়টি আমি জানি না। সিকিউরিটি টিমকে জানাচ্ছি। তারা বিষয়টি দেখবে।’
‘কাজী নজরুল ইসলাম হলে সকাল থেকে ভোট প্রদানের হার ছিল খুবই কম। বিকাল ৪টা পর্যন্ত এই হলে ভোট পড়ে চারশোর মতো। কিন্তু শেষদিকে ভিড় অনেক বেড়ে যায়। অভূতপূর্বভাবে এই হলে ভোট গ্রহণ করা হয় সন্ধ্যা সাতটারও বেশি সময়। এই হলে জিএস পদে মোট ৬ জন প্রার্থীর ঘোষিত ভোট সংখ্যা হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৫৬ ভোট। কিন্তু এই হলে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যা ৮০৬। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে নির্ধারিত সময়ের অনেক সময় পেরিয়ে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। আমরা প্রশাসনের কাছে সকল কেন্দ্রের ভোট প্রদানকারী ভোটারদের তালিকা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চাইলেও অদ্যবধি পাইনি।’
‘দৈনিক সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভোট দিতে এসে দেখি, আমার ভোট আগেই হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে আসা এক শিক্ষার্থী। আজ বৃহস্পতিবার শহীদ রফিক-জব্বার হলের ভোটকেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটে। ওই শিক্ষার্থীর নাম মো. রবিউল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি সমকালকে বলেন, 'আমি ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে এসে দেখি, আমার ভোট আগেই অন্য কেউ দিয়ে গেছে। জীবনের প্রথম ভোট এভাবে নষ্ট হবে, আমি কোনোদিন ভাবিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হলের পোলিং অফিসার মো. জাকির হোসেন এর সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রবিউলের ভোট অন্য কেউ ভুয়া আইডি কার্ড ব্যবহার করে দিয়েছে। পরে রবিউল যখন তার আসল আইডি কার্ড নিয়ে ভোট দিতে আসে, তখন সেটি যাচাই করে সত্যতা নিশ্চিত হই। আমরা বিষয়টি ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি।' নির্বাচন পরবর্তী সময়েও নানান গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নির্বাচন পরবর্তী এক প্রতিবেদনের ভাষা ছিল এরকম- 'তুমি জয়ী নও, গণনায় ভুল হয়েছে, দুঃখিত'। জাবি হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনায় অসঙ্গতি। এই পদে মোট চারজন প্রার্থী মিলে ভোট পেয়েছেন ৫০৯টি, যদিও হলটিতে সর্বমোট ভোট পড়েছে ৪৬৯টি।’
সম্মেলনে জাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন উপস্থিত নেতারা।