‘চলেন ভাই, শহীদ হয়ে আসি’—ছিল ফরহাদের শেষ কথা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ০৬:৫৬ PM , আপডেট: ০২ জুন ২০২৫, ০১:৪৬ PM
মাগুরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফরহাদ হোসেন। গত বছরের ৪ আগস্ট মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালী এলাকায় আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ২২ বছর বয়সী এই তরুণ। মৃত্যুর আগের সকালেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলন ও নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে বড় ভাইকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “চলেন ভাই, শহীদ হয়ে আসি।” সেটিই ছিল তাদের শেষ কথা।
শ্রীপুর উপজেলার রায়নগর গ্রামের ফরহাদ চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন। তার বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন এবং বড় দুই বোন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। তাদের বাবা গোলাম মোস্তফা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
ফরহাদ ছোট হলেও ছিলেন অত্যন্ত পরিপক্ব, দায়িত্বশীল ও সাহসী। পরিবার ও প্রতিবেশীদের মতে, তিনি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তার দৃঢ়তা এতটাই ছিল যে পরিবারের কেউই তাকে আটকাতে পারেননি।
ফরহাদের বাবা জানান, ছেলে প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলত, এমনকি আন্দোলনের মধ্যেও নিয়মিত ফোন করে খোঁজখবর দিত। মৃত্যুর দিনও সকালে পরিবারের সবার সঙ্গে কথা হয়েছিল। কেউই তখন ভাবেনি যে সেটাই হবে শেষবারের মতো তার কণ্ঠস্বর শোনা।
বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া বলেন, ফরহাদ তাকে আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানায় এবং শহীদ হওয়ার ইচ্ছার কথাও স্পষ্টভাবে বলে। তিনি চুপ থাকলে ফরহাদ তাকে ভীরু বলে দোষারোপ করে এবং তার জন্য দোয়া করতে বলেন, যেন আল্লাহ তাকে কবুল করেন।
দুপুর আনুমানিক দুইটার দিকে তারা মিছিলের সামনে চলে গেলে হঠাৎ করে বিপরীত দিক থেকে ধাওয়া শুরু হয়। সেই সময় ফরহাদের মাথায় একটি গুলি এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নছিমনে করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফরহাদের বড় বোন রোকেয়া খাতুন মৌসুমী বলেন, ফরহাদ ছোট হলেও পরিবারে অনেকটা অভিভাবকের মতো আচরণ করতেন। তার সাহস, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগের মানসিকতা ছিল ব্যতিক্রমী। ফরহাদের চাচা মো. ইসরাইল হোসেন জানান, ফরহাদ ছিলেন ধর্মপরায়ণ। সবসময় তার সঙ্গে একটি ছোট কোরআন শরিফ থাকত। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদও পড়তেন। নামাজে তার ভক্তিপূর্ণ মনোভাব ফুটে উঠত।
ঘটনার দিন সকালে রায়নগর থেকে সাতজনের একটি দল ইজিবাইকে করে কয়েকটি বাধা অতিক্রম করে পারনান্দুয়ালী এলাকায় পৌঁছে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ফরহাদের স্কুলবন্ধু ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন। সকাল ১১টার দিকে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। মহাসড়কে আগুন ও সংঘর্ষ দেখে অনেকে ভয় পেলেও ফরহাদ ছিলেন একেবারেই নির্ভীক।
দুপুর আনুমানিক দুইটার দিকে তারা মিছিলের সামনে চলে গেলে হঠাৎ করে বিপরীত দিক থেকে ধাওয়া শুরু হয়। সেই সময় ফরহাদের মাথায় একটি গুলি এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নছিমনে করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবার জানায়, ফরহাদের দাফন ময়নাতদন্ত ছাড়াই সম্পন্ন করা হয়েছে। তারা মামলা করেননি, কারণ মৃতদেহ পুনরায় উত্তোলন করতে হোক, এমনটি তারা চান না। তবে তারা সুবিচার চান এবং বিশ্বাস করেন, ঘটনাটি বহু মানুষের সামনে ঘটেছে—তাদের সাক্ষ্যই প্রকৃত বিচার নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
এ ঘটনায় সদর উপজেলার বীরপুর গ্রামের মো. জামাল হোসেন ২১ আগস্ট মাগুরা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তার দাবি, ঘটনার সময় ফরহাদ তার সামনেই গুলিবিদ্ধ হন। মামলায় মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ও মাগুরা-২ আসনের সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট বীরেন শিকদারসহ মোট ৬৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।