নতুন কমিটি হলে ছাত্রলীগ কি বদলাবে?

ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হবে নতুন নেতৃত্ব আসবে, তাতে ছাত্রলীগ কি বদলাবে?
ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হবে নতুন নেতৃত্ব আসবে, তাতে ছাত্রলীগ কি বদলাবে?  © সংগৃহীত

শাসক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলনকে ঘিরে এখন নানা প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতিতে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে প্রশ্ন করেছেন, এটা কি ছাত্রলীগ?” এই প্রশ্ন এখন আরো বিস্তৃত। ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হবে নতুন নেতৃত্ব আসবে, তাতে ছাত্রলীগ কি বদলাবে? ছাত্রলীগে কি পদ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির অবসান হবে?

নেতারা অবশ্য আশা করছেন, ‘‘ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা  চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্রলীগে পরিণত হবে।”

এটা কি ছাত্রলীগ

গেল শুক্রবার ছিলো ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ছাত্রলীগের সম্মেলন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্মেলনে হাজির হওয়ার পর নেতা-কর্মীরাও তার সঙ্গে মঞ্চে উঠে পড়েন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ওই উচ্ছৃঙ্খলা দেখে তিনি থামতে বললেও তারা থামেনি।

এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘‘এটা কি ছাত্রলীগ? কোনো শৃঙ্খলা নেই। অপকর্ম করবে, এমন ছাত্রলীগ দরকার নেই।”

আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা

এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভাট্টাচার্য। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘এটা কী ছাত্রলীগ। পোস্টার নামাতে বললাম তারা নামায় না। এরা কারা আমি খোঁজ নিচ্ছি। এতো নেতা স্টেজে, তাহলে কর্মী কোথায়? এই ছাত্রলীগ চাই না। শেখ হাসিনার ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ এই ছাত্রলীগ না।”

এই পরিস্থিতিতে মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক মঞ্চ ছেড়ে চলে যান।

আগামী ৬ ডিসেম্বর এই ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি হবে। এদের মধ্য থেকেই কেউ নতুন সভাপতি, কেউ সাধারণ সম্পাদক হবেন। তাতে ছাত্রলীগের গুণগত কী পরিবর্তন হবে?

একই পথে হাঁটছে সবাই

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় শোভন ও রাব্বানীকে টেন্ডারবাজির অভিযোগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজে উপাচার্যের কাছে তারা চার থেকে ছয় পার্সেন্ট চাঁদা দাবি করেছিলেন বলে অভিযোগ।

ছাত্রলীগকে শোধরানোর জন্য এরপর জয়-লেখককে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তাতে ওই চাঁদাবাজি চরিত্রের কোনো পরিবর্তন আসেনি। টেন্ডারবাজি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি এমন কী পদবাণিজ্যের কোনো অবসান ঘটেনি। আগে যেমন ছিলো তেমনই আছে।

সর্বশেষ ঢাকার ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি নেপথ্যে ছিলো সিট বাণিজ্য। ইডেন কলেজের হস্টেলে কমপক্ষে ১০০ সিটের নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য নিয়েই ছিলো ওই সংঘাত। শুধু টাকার বিনিময়ে সিট বরাদ্দ নয়, ওই সিটগুলোকে কেন্দ্র করে অনৈতিক বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে শিক্ষার্থীদের।

এর আগে গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হয়।

আরও পড়ুন: ছাত্রলীগ নেতাদের বিমান বিলাস

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত বছর ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এই সব ঘটনায় ছাত্রলীগের কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন।

২০২০ সালে ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। তাতে দুইজন নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়েছেন।আর অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা তো আছেই। হল দখল, ক্যান্টিনের নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিও থামেনি।

পদ বাণিজ্য

রাজশাহীতে ছাত্রলীগের সভাপতি পদ পেয়েছিলেন সাবেক শিবির নেতা সাকিবুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে নারীদের উত্যক্ত করার অডিও ভাইরাল হয়েছে। তাকে কোনো নিয়ম নীতি ছাড়াই লেনদেনের বিনিময়ে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে সভাপতি করা হয়েছিলো বলে অভিযোগ। বিতর্কের মুখে তার পদ স্থগিত হয়েছে।

সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি দেয়া হয় প্রেস রিলিজের মাধ্যমে।  অভিযোগ সাত মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি নাজমুল ইসলামকে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেছেন পদ নিয়ে বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে।

কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে এক নারীকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের' অভিযোগের মূলহোতা আশিকুল ইসলাম আশিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলে অভিযোগ আছে। যশোর জেলা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াসের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সেবনের অভিযোগ রয়েছে।

ফেনসিডিলসহ একবার তিনি পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছেন। ওই কমিটির নয় জনের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা, বিবাহিত, অছাত্র ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া মো. আল আমিন একজন অছাত্র।

ছাত্রলীগের ১২১টি ইউনিটের মাত্র ২৫টি ইউনিটের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে প্রথম দুই বছরে। ছাত্রলীগে পদ বাণিজ্য সিন্ডিকেট সক্রিয়। ঢাকার বিনিময়ে পদ দেয়ার যেমন অভিযোগ আছে। একইভাবে টাকার বিনিময়ে পুরনো কমিটি ধরে রাখার অভিযোগও আছে। আর কিছু কমিটিতে বিবাহিত এবং মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে যুক্তদের ঠাঁই পাওয়ার অভিযোগ আছে।

আর এখন শেষ মুহূর্তেও পদ বাণিজ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। কারণ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হলেও সব পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে অনেক সময় লাগবে। সেই সময় পর্যন্ত তারা থেকে যেতে পারবেন।

সম্মেলনকে সামনে রেখে চাঁদাবাজির অভিযোগ

৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কিছু নেতা চাঁদাবাজিতে নেমেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান,  ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা নিচ্ছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছ থেকেও শীর্ষ নেত্রত্বের নাম ভাঙিয়ে কৌশলে  টাকা নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।

সম্মেলনকে সামনে রেখে ১৬টি উপ-কমিটির নেতাদেরও কেউ কেউ চাঁদাবাজি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ, ছাত্রলীগের সম্মেলনের জন্য মঞ্চ তৈরি, আপ্যায়ন, সাজসজ্জা, প্রকাশনা, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বাস্থ্য ক্যাম্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আওয়ামীলীগ থেকে।  আর শেষ সময়ে কমিটির নামে চাঁদা নিয়ে যে যার পকেটে ভরছেন কোনো শৃঙ্খলাও নেই।

অভিযোগ ও প্রত্যাশা

ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কামাল খান বলেন, ‘‘বিগত কয়েকটি কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। এখনকার কমিটির কিছু সুবিধাবাদী নেতা পদবাণিজ্য, চাঁদাবাজিসহ অনৈতিক কাজে জড়িত। এদের সংখ্যা কম। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বেচ্ছাচারিতা এর জন্য দায়ী। গঠনতন্ত্র মানা হয়নি। ব্যক্তির ইচ্ছায় সংগঠন চালানো হয়েছে। ফলে খারাপ পরিসিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।”

শেষ সময়ে পদবাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগের কথা তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘‘ওই একই নেতারা এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। আমি শেষ সময়ে বেশি কিছু বলতে চাইনা। তাদের পক্ষে কিছু বলার নাই। তবে তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচার দাবি করছি।”

তবে তার প্রত্যাশা, ‘‘এবার যে নতুন নেতৃত্ব আসবে তারা সংগঠনকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারবে।” তার আশা, ‘‘এবার যোগ্য নেতৃত্বের হাতেই ছাত্রলীগকে দেয়া হবে। কারণ সামনে অনেক কঠিন সময়, নির্বাচন। এই সময়েই ছাত্রলীগই হবে শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড।”

আরও পড়ুন: এসি-ফ্রিজ নিয়ে রাজার হালে ঢাবির হলে থাকছেন চাকরিজীবী ছাত্রলীগ নেতা

আর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন মনে করেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে ছাত্রলীগ তা থেকে বর্তমান সময়ের ছাত্রলীগের বিচ্যুতি ঘটেছে। জিয়াউর রহমান ছাত্র রজানীতিকে কলুষিত করেছেন তার প্রভাব ছাত্রলীগেও পড়েছে। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে তার আদর্শের জায়গায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। ফলে অতীতে যখনই  তথ্য প্রমাণভিত্তিক অভিযোগ পাওয়া গেছে তখনই তিনি ব্যবস্থা নিয়েছেন।”

তার কথা, ‘‘ছাত্রলীগে যেমন ধান্দাবাজ, চাঁদাবাজ আছে। তেমনি মানুষের সংকটে পাশে দাঁড়ায় এমন নেতা-কর্মীও আছে। আমার আশা থাকবে এবার যে নতুন নেতৃত্ব আসবে তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। তারা ছাত্রলীগকে দুর্নামের গণ্ডি থেকে বের করে আনবে।”

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য ছাত্রলীগের বিদায়ী সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence