শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট করছে টিউশন শিক্ষকরা, বাড়ছে অনিয়মও
- শিউলী রহমান
- প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২০, ১১:৩৫ AM , আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২০, ০১:০৯ PM
করোনার কারণে প্রায় সাত মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত এই ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন টিউশনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আয় বন্ধ হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকেরও। বিশেষ করে যারা টিউশনি করে নিজেদের খরচ মেটাতেন, তাদের বিপদ বেড়েছে অনেক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সিংহভাগেরই টিউশনি চলে গেছে। তবে চলতি মাসে বিশেষ কারণে অনেকে ফিরে পেয়েছেন তাদের টিউশনি।
জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে আট মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিক্ষার্থীদের যে বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে তা তারা বাড়ি থেকে প্রস্তুত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জমা দিতে হচ্ছে। তবে স্কুল পর্যায়ে অনেক নতুন ও পরীক্ষামূলক এ পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে তিনটি করে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেয়ার কথা। সপ্তাহের শুরুতে শিক্ষার্থীর অভিভাবক বা পরিবারের অন্য কোন প্রতিনিধি স্কুলে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসছেন। সপ্তাহের শেষে স্কুলে গিয়ে সেই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেন অভিভাবকেরা। এই অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নে শিক্ষক কোন নম্বর দেন না। শিক্ষার্থীর এ সংক্রান্ত কাজ নিয়ে মন্তব্য করা হয়।
অনেকে বলছেন, এসব সমস্যার সমাধানে বড় ভূমিকা রাখছেন টিউশনি শিক্ষক, স্কুল শিক্ষক কিংবা অভিভাবকরা। ফলে শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারছেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ সুযোগে অনেকে অ্যাসাইনমেন্ট বিক্রিও করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্রির খবরও বেরিয়েছে। ফলে অ্যাসাইনমেন্টে মূল্যায়নের মূল যে উদ্দেশ্য, তাতে ব্যাঘাত ঘটছে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই বিষয়টিই স্বস্তির হয়ে এসেছে টিউশনি শিক্ষকদের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থীরই অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে পরিচিতি নেই। ফলে তাদের অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হচ্ছে। এতে ডাক পড়ছে টিউশনি শিক্ষকদের। তারা শিক্ষার্থীদেরকে অ্যাসাইনমেন্টসহ এ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন। এতে ফের তাদের আয়ের সুযোগও তৈরি হয়েছে। এ কারণে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের বিষয়টিকে অনেকে দেখছেন আশীর্বাদ হিসেবে।
অবশ্য কয়েকজন টিউশনি শিক্ষক জানিয়েছেন, অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের বিষয়টি একেবারেই নতুন হওয়ায় তাদেরও মানিয়ে নিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এ কারণে তাদেরও অন্যের সহযোগিতা নিচ্ছে হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে অন্য শিক্ষকের কিংবা পরিচিত যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তবে অভিযোগ উঠেছে, আর্থিক লেনদেনেরও।
শিক্ষকের অ্যাসাইনমেন্ট মিলছে দোকানে, শিক্ষার্থীরা কিনছেন ৩০ টাকায়!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক টিউশনি সংক্রান্ত অসংখ্য গ্রুপ গড়ে উঠেছে। সেখানে যারা অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করতে পারছেন তারা জানিয়ে দিচ্ছেন। যাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়টির অ্যাসাইনমেন্ট প্রয়োজন, তারা ওই শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। তবে এ সংক্রান্ত যোগাযোগ হচ্ছে মোবাইলে কিংবা ফেসবুক ইনবক্সে। ফলে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের বিষয়টি কীভাবে হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই অ্যাসাইনমেন্টে কাজে হাত দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ছে না শিক্ষার্থীরা।
সাদাত নামে একজন অভিভাবক বলেন, ‘এভাবে অ্যাসাইনমেন্টে মূল্যায়ন মোটেও ভালো খবর নয়। শিক্ষার্থীরা এতে কিছু শিখতে পারছে না। অন্য কেউ অ্যাসাইনমেন্ট করে দিলে করোনার কারণে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষানো যাবে না। এ জন্য এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল হাই বলেন, ‘এভাবে অ্যাসাইনমেন্ট করার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় অংশই তেমন কিছু শিখতে পারছে না। এতে শিক্ষায় তাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা থেকেই যাচ্ছে। পরবর্তীতে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হলে তারা আরও পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ঝড়ে পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।’
এ বিষয়ে শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের আমরা শেখাব, এর চেয়ে মূল্যায়নের গুরুত্ব বেশি না। মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত পাঠ্যসূচী থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি তারা। এখন নামকাওয়াস্তে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তাদের মূল্যায়ন হবে। এগুলো বাড়িতে শিক্ষার্থীরা নিজে করছে, নাকি অভিভাবক, প্রাইভেট টিচার বা বড় ভাই করে দিচ্ছে, তা কি বোঝার কোন উপায় আছে?’
অবশ্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণের জন্য ফি আদায় করা যাবে না বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এছাড়া মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে টিউশন ফি আদায় করবে, সে বিষয়ে শিগগিরই নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক।
তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের শিখনফল মূল্যায়ন করতে যে অ্যাসাইনেমন্ট নেয়া হচ্ছে সেজন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া যাবে না বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। টিউশন ফি আদায় করা নিয়ে আমরা শিগগিরই একটি নির্দেশনা দেব।’