৩২ বছরের অধ্যাপনার সমাপ্তি, অধ্যাপক তানজিদার বিদায়ে অশ্রুসিক্ত বাঙলা কলেজ
- কাজী আল তাজরীমিন, বাঙলা কলেজ
- প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১১:৫৬ PM , আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৮:৫৯ PM
সরকারি বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক তানজিদা হোসেন ৩২ বছরের অনন্য শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে বিদায় নিয়েছেন। এই বিদায় ছিল না কেবল একটি চাকরি ছাড়ার আনুষ্ঠানিকতা, বরং ছিল একটি প্রজন্ম গঠনের ইতিহাসের এক গর্বিত পরিসমাপ্তি। নিষ্ঠা, মমতা, সততা আর ভালোবাসার অধ্যায়টি তিনি যেভাবে রচনা করেছেন—তা চিরকাল শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।
বুধবার (৯ জুলাই) কলেজের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক হৃদয়ছোঁয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানান প্রিয় এই শিক্ষিকাকে। স্মৃতির সোনালি পাতায় লেখা অধ্যাপক তানজিদা হোসেনের কর্মজীবন যেন এক আবেগঘন নদীর ধারা, যা ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য হৃদয়।
দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ছিলেন শুধুই একজন শিক্ষক নন—ছিলেন অভিভাবক, পরামর্শদাতা, আশ্রয়স্থল। ক্লাসের পড়াশোনার সীমা ছাড়িয়ে তার স্নেহ আর মমতা ছড়িয়ে পড়েছিল অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবনে। কারো কোনো সমস্যা দেখলে নিজ থেকে খোঁজ নিতেন, পাশে দাঁড়াতেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই যে সহজাত প্রবৃত্তি—সেটিই তাঁকে আলাদা করে তুলেছে সবার মাঝে।
১৪তম বিসিএসের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন তিনি। প্রথম কর্মস্থল ছিল বগুড়ার সরকারি মজিবর রহমান ভান্ডারী মহিলা কলেজ। এরপর নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ (২০০১–২০০৪), কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ (২০০৪–২০০৮) এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালে সরকারি বাঙলা কলেজে যোগ দেন। তবে এর আগেও ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজেই শিক্ষকতা করেছিলেন। তাই এই বিদায়ের মুহূর্ত ছিল যেন নিজের ঘর ছেড়ে যাওয়ার অনুভূতি।
শিক্ষাজীবনে ময়মনসিংহ মুমিনুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে অনার্স (১৯৮৬) ও মাস্টার্স (১৯৮৭) সম্পন্ন করেন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আবেগঘন কণ্ঠে অধ্যাপক তানজিদা হোসাইন বলেন, শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, এটি ছিল ইবাদত সমতুল্য। একজন শিক্ষকের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তাঁর শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা। আমি তা পেয়েছি। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি চাই, ভালোবাসার মাধ্যমেই যেন স্মরণে থাকি আপনাদের হৃদয়ে।
অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ প্রফেসর কামরুল হাসান বলেন, জীবনে অঢেল সম্পদ অর্জন করার চেয়ে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পারাটাই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয়। শিক্ষকরা এখানেই সার্থক। প্রফেসর তানজিদা হোসেন একজন সৌভাগ্যবান শিক্ষক, তিনি শিক্ষার্থীদের মনে সেই স্থানটা অধিকার করতে পেরেছেন।
শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক নাহিদা পারভিন বলেন, শিক্ষকদের তো এইটুকুই প্রাপ্তি যে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের স্মরণে রাখবে। আমাদের শিক্ষকতা জীবনে যা কিছু করি, তার সবই তো আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য। আমরা প্রফেসর তানজিদা আপাকে সবসময় হাস্যোজ্জ্বল দেখেছি, তাঁর এই হাসিমুখটা আজীবন মনে থাকবে।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে গান গাইতে শুরু করলে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি প্রফেসর তানজিদা হোসেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর চোখের পানি যেন বলে দিচ্ছিল—এ শুধু চাকরি জীবনের সমাপ্তি নয়, এ এক ভালোবাসার অধ্যায়ের শেষ।
বিদায় শব্দটা যত ছোটই হোক, এর ভার অগাধ। প্রফেসর তানজিদা হোসেন সেই ভার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আর নিষ্ঠার সঙ্গে বহন করেছেন দীর্ঘ কর্মজীবন জুড়ে। তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষার আলো, মানবিকতা আর মমতার পরশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আগামীদিনের পথ চলায় অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।