সেশনজটে ভোগান্তি চরমে
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বছর হয় ১৮ মাসে!
- তামজিদ হোসেন মজুমদার, বব
- প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ০৪:২১ PM , আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৬ AM
উচ্চশিক্ষা জীবন স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ি হলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীদের জন্য তা যেন রূপ নিয়েছে এক দীর্ঘ ও অনিশ্চিত যাত্রায়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়েও সেশনজটের ঘোরতর সংকট থেকে মুক্তি পায়নি শিক্ষার্থীরা। ক্লাসরুম সংকট, শিক্ষক স্বল্পতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে শিক্ষার্থীরা সময়মতো ডিগ্রি অর্জন করতে পারছেন না। ফলে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেড় থেকে দুই বছর অতিরিক্ত ব্যয় করে তাদের অর্জন করতে হচ্ছে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এ কারণে শিক্ষাজীবন পেরোতে গিয়ে অনেকেই হারাচ্ছেন চাকরির সুযোগসহ গুরুত্বপূর্ণ সময়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২৫টি বিভাগের জন্য শ্রেণিকক্ষ রয়েছে মাত্র ৩৬টি। ফলে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে হয়। এতে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বিঘ্ন ঘটছে নিয়মিতই। শিক্ষক সংকট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৯৪ জন। প্রয়োজনের তুলনায় যা ৩৯ শতাংশ। এদের মধ্যেও ছুটিতে থাকা বা প্রেষণে কর্মরত শিক্ষকদের বাদ দিলে কার্যকর শিক্ষক সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে। ফলে সময়মতো ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে না, সেশনজট বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
শুধু শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট নয়, প্রশাসনিক দুর্বলতাও রয়েছে এই জটিলতার পেছনে। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় বিলম্বিত হচ্ছে পরবর্তী সেমিস্টারের কার্যক্রম। এমনকি কয়েকটি বিভাগে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের বিপরীতে চলছে একাধিক ব্যাচের ক্লাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত, ইংরেজি, রসায়ন, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, উপকূলীয় অধ্যয়ন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে সেশনজটের মাত্রা সবচেয়ে প্রকট।
আরও পড়ুন: মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষায় শেখ মুজিবকে নিয়ে প্রশ্ন, তোলপাড়
২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখনও দ্বিতীয় বর্ষে প্রবেশ করতে পারেননি এমন নজিরও রয়েছে। কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্লাস শুরু হলেও ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের মিডটার্মও শেষ হয়নি। মানসিকভাবে আমরা চরমভাবে বিপর্যস্ত। এই সেশনজট আমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, সময়মতো ডিগ্রি অর্জন করতে না পারায় কর্মজীবন শুরুতে দেরি হচ্ছে, পরিবার ও সমাজ থেকেও বাড়ছে চাপ। সেশনজটের কবলে ভোগান্তিতে পড়া এক শিক্ষার্থীর বলেন, ‘সবাই জিজ্ঞাসা করে, কবে পড়া শেষ হবে? উত্তর দিতে পারি না। আমরা চাই সময়মতো পরীক্ষা ও ফলাফল নিশ্চিত করে সেশনজটমুক্ত পড়াশোনার পরিবেশ।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা সেশনজটকে ‘অভিশাপ’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সেশনজটের কারণে আমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। আমরা সময়মতো ডিগ্রি অর্জন করতে পারছি না, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলছে। শিক্ষাজীবন শেষ করে একটি ভালো চাকরি বা কর্মসংস্থান খুঁজে বের করার জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না।’
তারা আরো বলেন, ‘সেশনজটের ফলে পারিবারিক ও সামাজিক চাপ বাড়ছে, সবাই জানতে চায়, কবে আমাদের পড়ালেখা শেষ হবে। আমরা সেশনজটমুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই। যেখানে আমরা সময়মতো ডিগ্রি অর্জন করতে পারব।’
আরও পড়ুন: গেজেটে নাম নেই ২৩ জুলাই শহীদের, অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় পরিবার
কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হলেও আজ ২০২৫ সালের জুলাই মাসে এসেও আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের মিডটার্ম পরীক্ষা শেষ হয়নি। যেখানে অন্যান্য ডিপ্ট এর ২০২২-২৩ সেশনের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ আমি এমন একটা ডিপ্টের কথাই বলতেছি যেখানে প্রতিটা স্টুডেন্টই মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে। আমাদের এই সংকট থেকে আমরা একন রেহাই চাই।’
বিষয়টি নিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ড. সুজন চন্দ্রপাল বলেন, ‘সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এতে মানসিক চাপ তো বাড়ছেই, সেইসঙ্গে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক স্বল্পতা প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিষয়টি নিয়মিত জানানো হচ্ছে। সব ব্যাচের একসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা আছে, প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. মুহসিন উদ্দীন বলেন, ‘সেশনজট নিরসনে বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে সভা হয়েছে। শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষক নির্ধারণে জটিলতা থাকায় ফল প্রকাশে দেরি হচ্ছে। এ জন্য একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপাচার্য এ বিষয়ে সচেষ্ট রয়েছেন। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের গঠিত কমিটির নির্দেশনার ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’