বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা কেন এক্সটার্নালরা মূল্যায়ন করেন?
- জুবায়ের রহমান
- প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২২ PM , আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০১:০৮ PM
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৬-এর ৪২ নম্বর ধারার ৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে প্রদত্ত প্রতিটি কোর্স, যাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি প্রদানের জন্য নির্ধারিত পাঠক্রমের অংশবিশেষ, উহা পরীক্ষণের জন্য দুইজন পরীক্ষক নিযুক্ত করিবেন, যাহাদের একজন অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত হইবেন।’ এর অর্থ হলো, প্রতিটি কোর্সের খাতা মূল্যায়নে কোর্স শিক্ষকের পাশাপাশি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্থাৎ এক্সটার্নাল দিয়ে খাতা মূল্যায়ন করাতে হবে।
যদিও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিয়ে খাতা মূল্যায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি একরকম নয়। তবে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
এদিকে খাতা মূল্যায়নে ইউজিসির কোনো নির্দেশনা আছে কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জামিনুর রহমান জানান, এ বিষয়ে ইউজিসির কোনো নির্দেশনা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নির্দেশনা রয়েছে।
একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য দুইজন পরীক্ষকের জাজমেন্ট দরকার। যদি শুধু একজন মূল্যায়ন করেন, তাহলে সিদ্ধান্তটি একপাক্ষিক হতে পারে। তাই একজন বাইরের পরীক্ষক রাখা হয়। যদি দুইজন পরীক্ষকের মধ্যে নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশ হয়, তাহলে খাতা তৃতীয় এক্সামিনারের কাছে যায়।-ড. মো. হাসনাত কবীর,ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রাবি
তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন—কেন খাতা মূল্যায়ন করেন এক্সটার্নালরা? কারা হন এক্সটার্নাল? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মো. হাসনাত কবীর জানান, একটি খাতা মূল্যায়নের জন্য দুইজন পরীক্ষকের জাজমেন্ট দরকার। যদি শুধু একজন মূল্যায়ন করেন, তাহলে সিদ্ধান্তটি একপাক্ষিক হতে পারে। তাই একজন বাইরের পরীক্ষক রাখা হয়। যদি দুইজন পরীক্ষকের মধ্যে নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশ হয়, তাহলে খাতা তৃতীয় এক্সামিনারের কাছে যায়।
এক্সটার্নাল কারা হন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যে কেউ হতে পারেন, ভেতরের বা বাইরের শিক্ষক। বিষয়টি বিভাগই নির্ধারণ করে। তারা নিজেদের মতো করে যাকে উপযুক্ত মনে করেন, তাকেই বেছে নেন। সাধারণত পরিচিতজনরাই থাকেন।
পরিচিতদের এক্সটার্নাল হিসেবে বেছে নিলে স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, এমনটা ভাবা ঠিক না। খাতা মূল্যায়নে শিক্ষককে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হয়। কোনো পরীক্ষায় তার পরিচিত কেউ থাকলে সেই শিক্ষক পরীক্ষা কমিটিতে থাকতে পারেন না— এটাই নিয়ম।
এক্সটার্নালের নাম বিভাগ প্রস্তাব করলেও প্রশাসন থেকে পরিবর্তন করে দেওয়ার নজির আছে কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, না, এমনটা হয় না। কারণ বিভাগের শিক্ষকরা ভালো জানেন কে কোন বিষয়ে দক্ষ।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নুরুল করিম চৌধুরী বলেন, আমাদের আইনেই এক্সটার্নালের বিষয়টি উল্লেখ আছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই এটি করা হয়। যদি দুই পরীক্ষকের নম্বরের পার্থক্য বেশি হয়, তখন তৃতীয় একজন পরীক্ষা করেন। এতে নিশ্চিত হয় যে কেউ বৈষম্যের শিকার হবেন না।
তিনি জানান, খাতাগুলো কাদের হাতে যাবে তা নির্ধারণ করে পরীক্ষা কমিটি। পরে উপাচার্য তা অনুমোদন দেন। প্রস্তাবিত ব্যক্তিরা সাধারণত বিভাগের শিক্ষকদের পরিচিত হয়ে থাকেন। প্রশাসন চাইলে নাম পরিবর্তন করতে পারে, তবে তা সচরাচর হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুয়ায়ুন কবির পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এক্সটার্নালের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং এক্সটার্নালের বিভিন্ন দিক নিয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা বলেন। তিনি জানান, এক্সটার্নালের মাধ্যমে খাতা মূল্যায়নের মূল কথাই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সাথে যাতে অবিচার করা না হয়। এজন্য পরীক্ষার খাতা মাঝে মাঝে তৃতীয় শিক্ষক দ্বারাও মূল্যায়ন করা হয় যদি নম্বরের পার্থক্য ২০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। এই পদ্ধতি দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই চালু রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হয়ত একক মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকতে পারে।
তিনি আরও জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনুষদের খাতা এক্সটার্নাল দিয়ে মূল্যায়নের জন্য বাহিরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় না। বরং নিজেদের বিভাগের দুইজন শিক্ষক এই খাতা মূল্যায়ন করেন ।নম্বরের পার্থক্য ২০% বেশি হলে বিভাগের মধ্যেই তৃতীয় শিক্ষক দ্বারা খাতা মূল্যায়ন করা হয়। কারণ পরীক্ষার ফল প্রকাশের সময় ৬০ দিন নির্ধারিত। অন্যকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা পাঠানো হলে ফল প্রকাশ করতে ৬ মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমাদের খাতাগুলো বিভাগের মধ্যেই মূল্যায়ন হয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই অধ্যাপক জানান, বিভাগীয় অ্যাকাডেমিক কমিটিই পরীক্ষা কমিটির নাম প্রস্তাব করেন । প্রশাসনের কাছে যে নামগুলো প্রস্তাবনা আকোরে যায় সচরাচর সে নামগুলোই অনুমোদন পায়। তবে কারো বিরুদ্ধে যদি কোনো গুরুতর অভিযোগ পাওয়া যায় এবং প্রশাসনের নজরে আসলে তাহলেই কেবল নামের প্রস্তাবনায় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এটি খুবই বিরল।
পরিচিত শিক্ষকদের এক্সটার্নাল হিসেবে রাখা হলে খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির সুযোগ থেকে যায় কি না—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক কবির বলেন, এই বিষয়গুলো শিক্ষকদের নৈতিকতা উপর নির্ভর করে। কেউ যদি চায় আমি ওর রেজাল্ট ভালো করতে দেব না, তাহলে ওই এক্সটার্নাল শিক্ষকের সাথে লিয়াঁজো করে প্রত্যাশিত ফলাফলে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এটি সম্পূর্ণ কোর্স শিক্ষকের নৈতিকতার ওপর নির্ভর করে।