চাকসু নির্বাচনও হবে, তবে...

চাকসু
চাকসু

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে  হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ১৭৫৩ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ বছরের ইতিহাসে নানা আয়োজনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কথা চিন্তা করে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তৎকালীন সময়ে গঠন করা হয়েছিলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাত্র ছয়বার এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন অধরা দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে।

সর্বশেষ সোমবার এক সমাবেশ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে এক মাসের সময় বেধে দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। মূলত ডাকসু নির্বাচনের ডামাডোল ও ছাত্রলীগের এমন চাওয়া-পাওয়ার প্রেক্ষিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, ‘চাকসু থাকলে যে কাজগুলো হত, এখনো সেই কাজগুলো হচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করার জন্য একজন ছাত্র উপদেষ্টাও রেখেছি আমরা। এর পরও যদি সবাই চায়, তবে নির্বাচন দিতে প্রস্তুত। সে ক্ষেত্রে নিবার্চনকে ঘিরে কোন ধরনের সহিংসতা এবং ক্যাম্পাসের স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট হবে না- এই মর্মে লিখিত স্ট্যাম্প জমা দিতে হবে। তবেই চবি প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে চাকসু নিবার্চন দেবে। 

তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চার বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন শহীদ আবদুর রব ও জিএস হন মোহাম্মদ ইব্রাহিম; ১৯৭২ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনে ভিপি হন শমসুজ্জামান হীরা ও জিএস হন মাহমুদুর রহমান মান্না; ১৯৭৪ সালের তৃতীয় নির্বাচনে ভিপি হন এসএম ফজলুল হক ও জিএস হন গোলাম জিলানী চৌধুরী; ১৯৭৯ সালের চতুর্থ নির্বাচনে ভিপি হন মাজহারুল শাহ চৌধুরী ও জিএস হন জমির চৌধুরী; ১৯৮১ সালের পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি হন জসিম উদ্দিন সরকার ও জিএস হন আবদুল গাফফার এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভিপি নির্বাচিত হন নাজিম উদ্দিন ও জিএস হন আজিম উদ্দিন। এরপর থেকে গত ২৮ বছরে আর কোনো নির্বাচন না হওয়ায় এখনো নাজিম উদ্দিন চাকসুর ভিপি হিসেবে পরিচিত। তবে দীর্ঘদিন চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তৎকালীন সময়ে নির্মিত চবির চাকসু ভবন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট ক্যান্টিন হিসেবেই বেশি পরিচিত। তাছাড়া ভবনটি পরিচর্যার অভাবে 'চাকসু ভবন' লেখাটিও অনেকটা মুছে গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩ এর ২২ নং ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ সদস্য বিশিষ্ট সিনেটে পদাধিকারবলে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকবে। নির্বাচন না হওয়ায় গত ২৮ বছর সিনেটে শিক্ষার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। যার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবী উপস্থাপন এবং আদায়ে পিছিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মনীতি মাথা পেতে নিতে হচ্ছে।  বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নির্বাচন, সিন্ডিকেট নির্বাচন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন সহ প্রতিটি সেক্টরের নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যহত থাকলেও দীর্ঘ ২৮ বছর অধরাই থেকে গেছে চাকসু নির্বাচন। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সম্প্রীতি এবং নেতৃত্বের সম্ভাবনা। এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। এই ছাত্র সংসদের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রীরা তাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলো,পাশাপাশি মত প্রকাশের সুযোগ ছিলো সবার এমন মন্তব্য করেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা।

চাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বললে তারা নির্বাচন নিয়ে প্রশাসনের অসহযোগিতার কথা জানান। বলেন, চাকসু নির্বাচন চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো শিক্ষার্থী নেই। অথচ প্রশাসনের সাড়া নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এর বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট চাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে চবি প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ দেখিনি আমরা। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা ইতোপূর্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেছি। তাতেও কোনো সম্ভাবনা দেখিনি। ক্যাম্পাসের সহাবস্থানের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসী সংগঠন ছাড়া সবার জন্য সহাবস্থানের ব্যবস্থা করবো আমরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল এর সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ক্যাম্পাসে সহাবস্থান তৈরির জন্য চাকসু নির্বাচন খুব গুরত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই চাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বিভিন্নভাবে তাগিদ দিয়ে আসছি। তাছাড়া চাকসু নির্বাচন না হওয়ায় ক্যাম্পাসের স্থিতিশীল পরিবেশ নেই। আমরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারছি না। আমরা চাই ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করা হোক এবং অতিসত্বর চাকসু নির্বাচন দেয়া হোক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এর সভাপতি প্রদিপ চাকমা বলেন, চাকসু নির্বাচন চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো শিক্ষার্থী আছে বলে মনে হয় না। চাকসু নির্বাচন না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়েছে। আমরা গত বছরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসানের নিকট একটি স্মারকলিপি দিয়েছি। তাছাড়া আমাদের আরও কয়েকটি কর্মসূচিতে চাকসু নির্বাচনের দাবি উল্লেখ ছিলো। ক্যাম্পাসের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী হবে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারা মনোনীত ছাত্রনেতারা কখনোই এমন পরিবেশ তৈরি হতে দিবে না। কারন এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই ক্যাম্পাসের সার্বিক বিষয় বিবেচনায় চাকসু নির্বাচন প্রয়োজন।

চাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন ‘ছাত্র সংসদ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটি সবার সমন্বিত প্রয়াসে সম্পন্ন করা সম্ভব। সবাই এগিয়ে আসলে আমরা চাকসু নিবার্চন দিতে শতভাগ প্রস্তুত।’ প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘চাকসু থাকলে যে কাজগুলো হত, এখনো সেই কাজগুলো হচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করার জন্য একজন ছাত্র উপদেষ্টাও রেখেছি আমরা। যিনি সার্বক্ষণিক ছাত্রদের সমস্যাগুলো দেখাশোনা করে থাকেন। এর পরেও যদি তারা চায় আমরা চাকসু নির্বাচন দিতে প্রস্তুত। তবে চবিতে বিগত সাড়ে তিন বছরে শিক্ষার যে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটা আমরা স্থবির করতে চাই না।

তাছাড়া ক্যাম্পাসে এখনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার মত পরিবেশ তৈরি হয়নি বলেও মন্তব্য করে উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন গ্রুপ, উপ-গ্রুপে বিভক্ত। তারা নিজেরাই বিভিন্ন সময়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সেগুলো শামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আর যেহেতু চাকসু নির্বাচনে সকল সংগঠন অংশগ্রহণ করবে। তাই এই নিবার্চনের সুষ্ঠু পরিবেশ কল্পনাতীত। তবে সকল ছাত্র সংগঠনগুলো যদি নিবার্চনকে ঘিরে কোন ধরনের সহিংসতা এবং ক্যাম্পাসের স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট হবে না। আর হলে সেটার দায়ভার তারা নেবে, এই মর্মে লিখিত স্ট্যাম্প জমা দিতে পারে। তবেই চবি প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে চাকসু নিবার্চন দেবে। 


সর্বশেষ সংবাদ