জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজার হালে অছাত্ররা, মানবেতর জীবনযাপন নবীন শিক্ষার্থীদের
- আবির আব্দুল্লাহ, জাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:১৬ PM , আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৮, ০৫:১৯ PM
‘ভর্তি হওয়ার আগে শুনতাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য হলে সিট বরাদ্দ থাকে। ভর্তি হওয়ার পরও স্বপ্ন ছিল যে হলে উঠে নিজের একটি সিট থাকবে, পড়ার জন্য টেবিল-চেয়ার থাকবে। কিন্তু এসে ঠাই হলো গণরুম নামক এক ভয়ংকর স্থানে।’ এভাবেই ভেঙ্গে যাওয়া মন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের কথা বলছিলেন প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী।
১৯৭৩ সালের প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী আবাসিক হলে অবস্থান করবে। বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকতে পারবে না। সে অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হলে একটি আলাদা আসন থাকার কথা থাকলেও তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে জাবি শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রতিবছর ধারণক্ষমতার বেশী নবীন শিক্ষার্থীর সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। ফলে তাদেরকে হলের কমন রুম, রিডিং রুম, সংসদ রুম, ছোট ছোট গণরুম, নামাজের কক্ষ, সাইবার রুমের মত স্থানে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সম্প্রতি ক্যাম্পাসে আগমন করা ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হলের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবক’টি হলে ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও ছোট ছোট গণরুমে গাদাগাদি করে থাকেন। এছাড়া তৃতীয় বর্ষের (৪৫তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীরাও আসন ভাগাভাগি করে থাকছেন। এমনকি কিছু হলে চতুর্থ বর্ষের (৪৪তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীদেরকেও আসন ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে। আবাসন সংকট লাঘবে গত কয়েক বছরে ৪টি নতুন হল শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হলই মেয়েদের। ফলে মেয়েদের আবাসন সংকট অনেকটা কমলেও ছেলেদের ভোগান্তি কমেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে আসন যথাক্রমে- আল বেরুনী হলে ৪২৪টি, মীর মশাররফ হোসেন হলে ৭২০টি, শহীদ সালাম বরকত হলে ৪০০টি, আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলে ৪০০টি, মওলানা ভাসানী হলে ৭৬৮টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৭৬৮টি, শহীদ রফিক জব্বার হলে ৬৪০টি, নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে ৩৪০টি, ফজিলাতুন্নেছা হলে ২৫২টি, জাহানারা ইমাম হলে ৫০৪টি, প্রীতিলতা হলে ৫০৪টি, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৫১২টি, শেখ হাসিনা হলে ৬৪৮টি, সুফিয়া কামাল হলে ৫২৫টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৬৩২টি ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৫২৫টি।
এর বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। ফলে হলগুলোতে আসনের চেয়ে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী সংযুক্ত করা হয়। এক সিটে অনেক শিক্ষার্থীদেরকে ভাগাভাগি করে থাকতে হয়।
এছাড়া ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের রুম দখল সিট সঙ্কটে বড় ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিটি কক্ষে এসব ছাত্র নেতারা ২ বা ১ জন করে থাকেন। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও ক্ষমতাবলে দীর্ঘদিন যাবৎ রুম দখল করে রাখছেন তারা। এর জন্য হল প্রশাসনের নীরব ভূমিকাকেই দায়ী করছেন শিক্ষার্থীরা। এমনকি ছেলেদের হলের কোন রুমে কে থাকবে তাও হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই নির্ধারণ করেন।
এছাড়া শিক্ষা জীবন শেষেও হল ছাড়ছেন না স্নাতকোত্তর সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের হল ছাড়ার নোটিশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েও নানা অজুহাতে অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন তারা। এসব অছাত্রদের হলে অবস্থান আবাসন সংকট বাড়িয়ে তুলছে।
অন্যদিকে সেশন জটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সময় মত শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারছেন না। শিক্ষা জীবন শেষ হতে বেশি সময় লাগায় স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে বেশি সময় হলে অবস্থান করতে হচ্ছে। এটাও আবাসন সংকট তীব্র করতে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি ব্যাচ অধ্যয়নরত।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প ইতোমধ্যে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১০তলা বিশিষ্ট ৬টি আবাসিক হল নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোন আবাসিক সংকট থাকবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা আবাসিক সংকট নিরসনে তাৎক্ষনিক চেষ্টাও করে যাচ্ছি। হলের প্রভোস্টরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এ সমস্যা সমাধান করা সহজতর হবে।