ফুলপরীর ঘটনায় কী শিখলো ইবি ও ছাত্রলীগ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৩, ০২:০৩ PM , আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৪:২৩ PM
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় যেকোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী যখন এ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রবেশ করে তখন তাঁর চোখে থাকে অসংখ্য স্বপ্ন আর সামনে থাকে সাফল্যময় ভবিষ্যতের হাতছানি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা এবং একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তবে বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে তৈরি হচ্ছে ভিন্ন গল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নবীন শিক্ষার্থীদের চোখে স্বপ্নের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে র্যাগিংয়ের ভয় আর আতঙ্ক।
সম্প্রতি র্যাগিংয়ের কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে নাম এসেছে ছাত্রলীগের। এদের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের নামে ছাত্রলীগ নেত্রীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় হাইকোর্ট বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রভোস্টকে অপসারণের নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এই নির্দেশ শুধুমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই এক নতুন দৃষ্টান্ত।
আরো পড়ুন: ইবি প্রক্টর-প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি
শাখা ছাত্রলীগের দাবি, তারা সব সময় র্যাগিংয়ের বিপক্ষে ছিলেন। তবে এই ঘটনার পর এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকবেন। ছাত্রলীগ সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ‘সংগঠন কখনো কাউকে এধরনের কিছু করার নির্দেশ দেয় না যা শিক্ষার্থীদের স্বার্থবিরোধী। কিন্তু অনেকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে করা কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। সর্বশেষ এই ঘটনার পর আমরা এ বিষয়ে আরো সচেতন। প্রতিটি নেতা-কর্মীকে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে তারা এধরনের কোনো কিছুতে না জড়ায়।’
ইবি প্রক্টর বলেন, হাইকোর্টের এই রায় শুধুমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয় সকল বিশ্ববিদ্যালয়কেই একটি বড় বার্তা দিয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং আগে থেকেই নিষিদ্ধই ছিল। র্যাগিং বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণাও চালু ছিল। তবে আমাদের আরো সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল। আশা করি এই ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করায় ভবিষ্যতে আর কেউ এধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার সাহস পাবে না। এছাড়া, এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আমরা বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো।
আরো পড়ুন: অভিযুক্তদের সহযোগিতা করেছিলেন ইবি প্রভোস্ট
ইবির ঘটনা থেকে ছাত্রলীগ কি বার্তা নিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘ছাত্রলীগ র্যাগিংয়ের ঘটনায় অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ইবির ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগ কোনো অন্যায়কেই প্রশ্রয় দিবে না। আর র্যাগিং বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রুপ নিচ্ছে। তাই র্যাগিংমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও সর্বোচ্চ কঠোর হতে হবে এবং ছাত্র শিক্ষক সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এছাড়া, ইবিতে র্যাগিংয়ের ঘটনার পর বিগত কয়েকদিন যাবত ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে র্যাগিংবিরোধী সমাবেশ এবং প্রচারণা করছে ছাত্রলীগ। এছাড়া, প্রতিটি ইউনিটের কর্মীদেরই এধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশকে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাগত জানালেও বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। হাইকোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দীন খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফুলপরী নির্যাতনের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এসব ঘটনায় মহামান্য হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হলো! যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা। সেই জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের জন্য একটা অনন্য নজির তৈরি হলো। প্রশাসন যে ব্যর্থ এটা আমরা এতদিন আমরা মুখে বলে আসছি। কিন্তু মহামান্য আদালতের হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে এটাও একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ তৈরি হলো।
আরো পড়ুন: ‘ইবি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় আদালতের হস্তক্ষেপ প্রশাসনিক ব্যর্থতা’
তিনি আরও বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্বের অবহেলা আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দেখে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, সুস্থ-স্বাভাবিক ও পড়াশোনার পরিবেশ বজায় রাখা এটা প্রশাসনের প্রতিদিনের ব্যর্থতা। প্রক্টর অফিস থেকে শুরু করে হল অফিসে এ ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের আছে। এখন আদালতের রায়ের মাধ্যমে এ ঘটনা আবার সবাই জানলো। যেগুলো নিয়ে আমরা সবসময় বলে থাকি। এ ঘটনাগুলো কেন ঘটে এবং কীভাবে ঘটে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের যে পুরোটায় দায়। সেটা আবারো নিশ্চিত হল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে আনন্দের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করে, নতুন আবিষ্কারে ব্যস্ত থাকে সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা আতংকে দিন কাটায়। ইবির ঘটনাটি সামনে এসেছে কিন্তু অনেক ঘটনাই সামনে আসছে না। কম-বেশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটছে। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বর্ণনা শুনে শিউরে উঠি। সবচেয়ে ভয়ংকর এবং দু:খজনক বিষয় হলো অধিকাংশ সময় প্রশাসনের ছত্রছায়ায়, বিভিন্ন শিক্ষকদের ছত্রছায়ায়ই এসব নির্যাতন হচ্ছে। আর একারণেই ইবির ঘটনায় হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
এধরনের পরিস্থিতির জন্য সকলেই দায়ী উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, শিক্ষার্থীরা যে পরিবেশে বাস করছে সেটি কোনো পড়ালেখার উপযোগী পরিবেশ নয়। তারা প্রতি মুহূর্তে আতংকে কাটায় আর এই পরিস্থিতির জন্য আমরা সকলেই দায়ী। প্রশাসন সব দেখেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বরং নির্যাতনকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, সাংবাদিকরা চুপ থাকছে, অভিভাবকরা সব জেনেও প্রতিবাদ করছে না, আমরা শিক্ষকরা এসব বন্ধে কার্যকর কিছু করছি না। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের এই সবকিছু থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে।
আরো পড়ুন: ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী নির্যাতনে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ভেঙে দেওয়ার আহ্বান
এধরনের ঘটনা এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিরপেক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এধরনের ঘটনা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং সব শিক্ষার্থীকে সমানভাবে দেখতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে শৃঙ্খলা মেনে চলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থী যে দলের, মতেরই হোক অপরাধে জড়ালে তাকে শাস্তি দিতে হবে। হল থেকে বহিষ্কার, ছাত্রত্ব বাতিল এইধরনের শাস্তিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রশাসনিক ক্ষমতায় দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় সকল শিক্ষার্থীকে যখন সমানভাবে দেখবে এবং সকল অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিবে তখন এধরনের ঘটনা কমে আসবে।
এসময় তিনি আরো বলেন, একজন শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। এই সময়ের মধ্যে তার মন-মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তার মন মানসিকতা পরিবর্তনের খুব বেশি সুযোগ থাকে না। তাই আমাদের উচিত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র একাডেমিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব না দিয়ে সে কতটা ভালো মানুষ হয়ে উঠলো সে বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা। একজন শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র জিপিএ দিয়ে বিবেচনা না রে সে সত্যি বলছে কিনা, তার মধ্যে মানবিক গুণাবলি তৈরি হয়েছে কিনা এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা।