নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে বাংলাদেশে সমন্বিত আইন-নীতিমালা হওয়া দরকার

ইউআইইউতে পর্দা নামল নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্মেলনের

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ একটি নীতিমালা এবং সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা উচিত।

শনিবার (৯ মার্চ) নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়ন ও প্রযুক্তি বিষয়ক ৭ম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের (আইসিডিআরইটি-২০২৪) শেষদিনে গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা বলেন তারা। এর আগে বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ক্যাম্পাসে এ তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ইউআইইউ’র ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ এই সম্মেলনের আয়োজন করে। 

সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। এছাড়াও দেশে প্রচলিত জরুরি জ্বালানি আইন বাজার ব্যবস্থায় অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। সেজন্য এটি বিলোপ করে সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। 

তিন দিনব্যাপী এবারের সম্মেলনের শেষদিন গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, তারা ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইউরোপীয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশন) কান্ট্রি লিড মনোয়ার মুস্তফা।

এছাড়াও গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্রিন ইনক্লুসিভ অ্যান্ড সোশ্যাল প্রটেকশনের টিম লিডার এডউইন কেওক কেওক, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ইঞ্জি. মো. হাবিবুর রহমান, বিদ্যুৎ বিভাগের পরিচালক মো. হোসেন, ইউকলের সিইও আলমগীর মোর্শেদ প্রমুখ। 

দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন, বিনিয়োগ, বিপণন, বাজারজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা থাকা দরকার জানিয়ে আলোচকরা বলেন, এ নিয়ে দেশে প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী সংগঠন বা সংস্থাও থাকা উচিত।

এছাড়াও সম্মেলনের শেষদিনের গোলটেবিল আলোচনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে বৈশ্বিক নানা প্রেক্ষিত এবং বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এসময় আলোচকরা, বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত সম্ভাবনা এবং করণীয় বিষয়গুলো তুলেন।

আলোচনায় উঠে আসে, দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত শিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞান বিনিময় ও ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলোও। পাশাপাশি এখাতের ভবিষ্যৎ জনবল এবং উচ্চশিক্ষার বিষয়গুলোও তুলে ধরা হয়েছে এবারের সম্মেলনে। একই সাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে চলমান গবেষণা এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি গবেষণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে।

গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করছে এবং খাতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখানে ভূমি অধিগ্রহণ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভূমির স্বল্পতা এর কারণ বলেও জানান তিনি।

মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সম্মেলনে বেশকিছু ভালো দিক উঠে এসেছে এবং আমরা তা গ্রহণ করছি। সম্মেলনের প্রস্তাবনা এবং সুপারিশ সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে এবং সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় ভূমি সমস্যা সমাধানে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। এছাড়াও দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা জরুরি বলেও জানান তিনি।

এবারের সম্মেলনে যেসব গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে তা এ খাতে আগামীদিনের চ্যালেঞ্জ উত্তরনে কাজে দেবে। সরকার সবুজ জ্বালানি নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি এবং এটি চলমান রয়েছে--বলেন সরকারের এ সিনিয়র সচিব।

সম্মেলনের শেষদিনে গোলটেবিল আলোচনায় মডারেটর হিসেবে ছিলেন আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের অর্গানাইজিং চেয়ার এবং ইউআইইউ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর এমেরিটাস ড. এম. রিজওয়ান খান। সম্মেলনের শেষদিনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের অর্গানাইজিং কো-চেয়ার এবং ইউআইইউ সিইআরের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী।

আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি এবং অ্যাকাডেমিয়ার একসাথে কাজ করা উচিত। শুধু জ্বালানি খাত নয় বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও সবার একসাথে কাজ করা দরকার বলেও জানান উপাচার্য।

আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের অর্গানাইজিং চেয়ার এবং ইউআইইউ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর এমেরিটাস ড. এম. রিজওয়ান খান বলেন, সম্মেলন ঘিরে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। আমরা আশা করছি, সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত নীতিমালা আলোচ্য বিষয়গুলো গ্রহণ করা হবে এবং বাংলাদেশ তার থেকে সর্বোচ্চ সুফল পাবে।

এর আগে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে চারটি মূল প্রবন্ধ এবং মোট ২৪টি আলাদা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে। এদিন আলাদা ২৪টি ধারাবাহিক সেশনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এর ব্যবহার, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়সহ সামগ্রিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।

শুক্রবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন সোলার সেলের সহ-সংযোজন এবং রচনামূলক প্রকৌশল, জ্বালানি ব্যবস্থায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ভূমিকা, পুনঃনবায়নয়যোগ্য শক্তি, গ্রিড ইন্টারেক্টিভ বিল্ড এবং ডিকার্বনাইজেশনের ভূমিকা এবং উচ্চ নবায়নযোগ্য গ্রিড ও দৃষ্টিভঙ্গির অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়েছে।

সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে আলোচকরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়ন অর্থনৈতিকভাবে কিভাবে লাভবান হবে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। এছাড়াও সম্মেলনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এ খাতের চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা করা হয়।

বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং এখাতে নানা চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আলোচনায় আসে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎস নিয়েও। আলোচকরা জানান, দেশের তিন পার্বত্য অঞ্চল থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাংলাদেশ পেতে পারে। এছাড়াও সিলেট অঞ্চলের চা বাগানসহ নানা সম্ভাবনাময় স্থানের বিষয়েও আলোচনা করেন বক্তারা। 

তিন দিনব্যাপী এবারের আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনে কানাডা, তুরস্ক, নেপাল, ভূটান, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হবে। এসব গবেষণা বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী কাজে আসবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। এ বছরের সম্মেলনে ৫টি গবেষণা প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা এবং ১টি ইনভাইটেড সেশন উপস্থাপন করা হয়। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে বিভিন্ন টেকনিক্যাল সেশনে দেশ-বিদেশের জ্বালানি গবেষণার ওপর দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইউআইইউ'র উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের টেকনিক্যাল চেয়ার প্রফেসর ড. ইস্তেখাব আলম। সম্মেলনের শেষদিনে গোলটেবিল আলোচনায় সুপারিশ ও প্রস্তাবনা জানানো হয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে। শনিবার সম্মেলনের শেষদিনে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোটগ্রহণ শেষে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা সপ্তম নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়ন ও প্রযুক্তি বিষয়ক এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের।

সম্মেলনের শুরুতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের অর্গানাইজিং চেয়ার এবং ইউআইইউ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর এমেরিটাস ড. এম. রিজওয়ান খান, ইউআইইউ'র স্কুল অব সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিন প্রফেসর ড. হাসান সারওয়ার এবং আইসিডিআরইটি'২৪ সম্মেলনের অর্গানাইজিং কো-চেয়ার এবং ইউআইইউ সিইআরের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী।

প্রসঙ্গত ইউআইইউ ২০০৯ সাল থেকে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলটির আয়োজন করে আসছে এবং এবারের সম্মেলন ইউআইইউ'র ৭ম আয়োজন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক এবং অন্যান্যরা।


সর্বশেষ সংবাদ