শিক্ষার্থীদের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টিদের ইউরোপ ভ্রমণ

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি  © ফাইল ফটো

শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি’র টাকায় সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) সদস্যদের যুক্তরাজ্যে ভ্রমণের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, ওই টাকায় উপহার-সামগ্রী কিনেছেন বোর্ড সদস্যরা। যাতে খরচ হয়েছে মোট ২১ লাখ টাকা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্রে জানা যায়, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিওটির সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমেদসহ বিদেশে থাকাকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের অন্য সদস্যরা লন্ডন যাওয়া-আসার বিমান ভাড়া নিয়েছেন। এছাড়া দেশে অবস্থানকালে গাড়ি ভাড়া ও উপহার সামগ্রী গ্রহণ করেছেন। বিমান ভাড়া, গাড়ি ভাড়া ও উপহার সামগ্রীর মূল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে।

বিদেশে অবস্থানকালে লন্ডনে যাওয়া-আসার বিমান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। যদিও এই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে সমন্বয়ের কথা জানিয়ে ইউজিসিকে চিঠি পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে ট্রাস্টিদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি নৈতিকতার মানদন্ডে ‘দুষ্ট’ এবং ট্রাস্টের নিয়মের লঙ্ঘন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি সতর্ক করে ইউজিসি।

‘যদি দুই/একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ট্রাস্টি এমন কোনো প্রোগ্রামে যান যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তাহলে হয়তো বিষয়টি  গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু তাদের প্রমোদ ভ্রমনের জন্য হলে তা অবশ্যই অনৈতিক’— অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, সদস্য, ইউজিসি

গত ৩ অক্টোবর এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকে চিঠি পাঠানো হয়। ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সাবেক চেয়ারম্যানসহ সকল সদস্যদের সতর্ক করা হয়।

ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যদি দুই/একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ট্রাস্টি এমন কোনো প্রোগ্রামে যান যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে তাহলে হয়তো বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু তাদের প্রমোদ ভ্রমনের জন্য হলে তা অবশ্যই অনৈতিক।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমেদের বিদেশে ভ্রমণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নূসরাত মাহমুদ চৌধুরী। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শামীম আহমেদ বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডে নেই। তিনি যে অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে খরচ করেছিলেন তা ফেরত দিয়েছেন। এটি মীমাংসিত বিষয়।’

‘ইউজিসির নির্দেশনা প্রাপ্তির পূর্বেই গত ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অর্থ কমিটির সভায় শামীম আহমেদ স্ব-প্রণোদিত হয়ে উনার পূর্বে গ্রহণকৃত ভ্রমণ ভাতা বাবদ গ্রহণ করা ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে সমন্বয় করেছেন যা পরবর্তীতে ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত হয়।

বিওটির চেয়ারম্যান ছাড়াও ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেক অর্থ নেওয়া এমনকি দেশে থাকাকালীন গাড়ি ভাড়া ও উপহার সামগ্রী নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

দায় স্বীকার বিওটি চেয়ারম্যানের 
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অর্থে ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমেদের লন্ডন যাওয়া-আসা বাবদ বিমান ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ৩১ অক্টোবর এ বিষয়ে ইউজিসিকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তারা।

ইউজিসিতে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) নূসরাত মাহমুদ চৌধুরী। চিঠিতে বলা হয়, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শামীম আহমদ এর ভ্রমণ ভাতা গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টির ব্যাপারে আপনার অবগতির জন্য কিছু তথ্য অবহিত করতে চাচ্ছি। আপনার নির্দেশনা প্রাপ্তির পূর্বেই গত ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অর্থ কমিটির সভায় শামীম আহমেদ এসআইইউ এর বর্তমান আর্থিক সংকটের কথা বিবেচনা করে স্ব-প্রণোদিত হয়ে উনার পূর্বে গ্রহণকৃত ভ্রমণ ভাতা বাবদ গ্রহণ করা ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে সমন্বয় করেছেন যা পরবর্তীতে ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় গৃহীত হয়।’

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকে আরও যত নির্দেশনা
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একাধিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ‘‘কোভিড-১৯, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর দ্বন্দ্ব, দুর্বল নেতৃত্ব এবং মামলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি আর্থিক সংকটে রয়েছে। সে বিবেচনায় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া পাওনাদি পরিশোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ, সদস্য, ইউজিসি

আইনানুযায়ী সাধারণ তহবিল পরিচালনা এবং কোনোভাবেই যেনো এর ব্যত্যয় না ঘটে; সে বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই দশকেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাশানুযায়ী বিকশিত হতে পারেনি। গত কয়েক বছরে কোভিড-১৯, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর দ্বন্দ্ব, দুর্বল নেতৃত্ব এবং মামলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। সে প্রেক্ষাপটে, সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নিমিত্ত কমিশনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নতুন প্রোগ্রাম ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আগামী তিন মাসের মধ্যে উল্লিখিত অনিরীক্ষিত অর্থ বছরসমূহ (২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২)-এর নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল বিভাগে পূর্ণকালীন কমপক্ষে একজন করে অধ্যাপক/সহযোগী অধ্যাপক জরুরী ভিত্তিতে নিয়োগ ও কমিশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী পূর্ণকালীন কোনো শিক্ষক কোনো সেমিস্টারে একইসাথে ৩-৪ টির (তিন থেকে চার) বেশি কোর্স না পড়ান; সে বিষয়টি নিশ্চিতপূর্বক সকল বিভাগে আগামী দুই মাসের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।’’

অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম, উপাচার্য, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

এছাড়া ‘‘কমিশনের ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের পাশে টু স্টার উত্তোলনসহ আইনি সহযোগিতা খাতের ছাড়কৃত সমন্বয়বিহীন পাঁচ লাখ টাকা আইন বিভাগের প্রধান হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে আদায়পূর্বক সাধারণ তহবিলে জমা দিতে হবে। উক্ত টাকা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ করা না হলে বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও আইনি খাতে অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা, বার কাউন্সিলের নির্দেশনা অমান্য করে আইন বিভাগের সভাপতি হিসেবে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির সম্মুখীন এবং বিপুল অংকের জরিমানা ও আইনি বিড়ম্বনা সৃষ্টির জন্য আইন বিভাগের প্রধান হুমায়ুন কবির-কে সকল প্রশাসনিক পদ হতে অপসারণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। ভবিষ্যতেও তিনি যেন কোন প্রশাসনিক পদ যেমন, ডিন, বিভাগীয় প্রধান, প্রক্টরিয়াল বড়ি, সিন্ডিকেট সদস্য, অর্থ কমিটির সদস্য ইত্যাদি পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হলো।’’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আশরাফুল আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে ফোনে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। মন্তব্য নিতে হলে আপনাকে ক্যাম্পাসে আসতে হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ