আমি একজন মা, আমি একজন নারী

ডা. মাহমুদা মিতু
ডা. মাহমুদা মিতু  © সংগৃহীত

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ডা. মাহমুদা মিতু বলেছেন, আমি একজন মা। আমি একজন নারী। এই পরিচয় থেকেই আমি রাষ্ট্রকে দেখি, শুধু ক্ষমতার কাঠামো হিসেবে নয় বরং সন্তানদের ভবিষ্যৎ, জীবনের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে। শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ মন্তব্য করেন তিনি।

ফেসবুক পোস্টে ডা. মাহমুদা মিতু বলেন, গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে আমরা দেখেছি ,বিএনপি–জামায়াতসহ ইসলামী ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলো পারস্পরিক জোট ও নির্বাচনী ঐক্যের ভিত্তিতে একসাথে সংগ্রাম করে এসেছে। ২০০১ সালে জোট সরকার গঠনের সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াত ছিল একটি প্রধান সহযোগী শক্তি। কিন্তু ১/১১ পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে খুনি হাসিনার টানা পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনে এই রাজনৈতিক ঐক্যকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। একজন নারী হিসেবে আমি জানি, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কেবল বন্দুক, আইন বা কারাগার যথেষ্ট নয়। দরকার হয় মানুষের মন দখল করা, নৈতিক বোধ ভেঙে ফেলা, ভয়কে স্বাভাবিক করে তোলা। এই কাজটিই করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির নকশায়, আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তথাকথিত ‘চেতনা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’।

আরও পড়ুন : পদত্যাগ করবেন না সামান্তা শারমিন, কারণ হিসেবে যা বললেন

তিনি বলেন, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের নির্মাণ এবং ৫ মে শাপলা চত্বরে সংঘটিত গণহত্যা, এই চেতনা ইন্ডাস্ট্রির আদর্শিক ও নৈতিক বৈধতায় চালানো রাষ্ট্রীয় কিলিং অপারেশন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর করা হয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের ভেতর দিয়ে আমরা নারীরা বেঁচে থেকেছি, প্রতিদিন ভয় নিয়ে। সন্তান ঘরে ফিরবে কি না, স্বামী রাতে ফোন ধরবে কি না, ভাই হঠাৎ গুম হয়ে যাবে কি না!! এই আতঙ্ক ছিল আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বাংলাদেশ তখন বিরুদ্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কণ্ঠগুলোর জন্য এক উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছিল। গুম ছিল নিত্যদিনের ভয়, আর ‘ক্রসফায়ার’ হয়ে উঠেছিল শাসনের ভাষা। যাদের গুম করা হয়েছে, যাদের হত্যা করা হয়েছ তাদের সবাইকে একই ছাঁচে ফেলে চিহ্নিত করা হয়েছে: “মৌলবাদী”, “জঙ্গি”, “স্বাধীনতাবিরোধী”, “রাজাকার”। 

তিনি আরও বলেন, একজন মা হিসেবে আমি জানি ,এই শব্দগুলো কেবল অপবাদ নয়, এগুলো ছিল সন্তান হত্যাকে বৈধ করার আদর্শিক অস্ত্র। ঠিক এই কারণেই ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা যখন হল থেকে বিদ্রোহের সূচনা করেছিল, তখন সেই শ্লোগান ছিল ইতিহাস বদলে দেওয়ার এক সৃষ্টিশীল ও সাহসী উচ্চারণ “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!” এই শ্লোগান শুধু প্রতিবাদ ছিল না। এটি ছিল ভয়ের রাজনীতি, অপপ্রচার আর চেতনা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির চাপিয়ে দেওয়া নৈতিকতার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রত্যাখ্যান। একজন নারী হিসেবে আমি বুঝেছিলাম ,এই মুহূর্তে ইতিহাসের দিক বদলেছে। আর এটাও সত্য ,২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের প্রাণ ছিল নারীরা।

আরও পড়ুন : শহীদ হাদির আসনে এনসিপির প্রার্থী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

ডা. মিতু বলেন, মায়েরা সন্তানকে রাস্তায় যেতে দিয়েছে।বোনেরা সামনে দাঁড়িয়েছে।ছাত্রীদের কণ্ঠ থেকেই প্রথম বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছে। নারীরা শুধু অংশগ্রহণ করেনি ,নারীরাই এই বিপ্লবের নৈতিক শক্তি, সাহস আর ধারাবাহিকতা জুগিয়েছে। জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় ঐক্যের পাটাতন তৈরি হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল এই গভীর উপলব্ধি । আওয়ামী চেতনা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির  মাধ্যমে সমাজে ঢুকিয়ে দেওয়া বিষাক্ত বিভাজন না ভাঙলে প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। 

তিনি বলেন, এই চেতনা ইন্ডাস্ট্রি গুঁড়িয়ে না দিলে বাংলাদেশ কখনোই সত্যিকারের স্বাধীনতা ফিরে পাবে না। এই উপলব্ধিকে যাঁরা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে রূপ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন, শহীদ বীর ওসমান হাদী ছিলেন তাঁদের একজন। ঠিক এই কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আজ আর বোঝা কঠিন নয় কেন আমাদের ভাই ওসমান হাদীকে জীবন দিতে হয়েছে, কারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, কারা ঘাতকদের সহায়তা করেছে, আর কীভাবে তারা নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে। আজ আমরা দেখছি এই চেতনা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি যারা খুলেছিলো তারা পরাজিত, বিষাক্ত অবশেষ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

তিনি আরও বলেন, বিএনপির ভেতরের কিছু পুরনো মোড়ল এই পতিত চেতনার ওপর ভর করেই আবার ক্ষমতায় পৌঁছাতে চায়। তাদের বক্তব্য, প্রশ্রয় আর বয়ান সেই পুরনো ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসকেই পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা কিন্তু আমরা ভুলে যাইনি। ১৯৭৫ সালের জিয়াউর রহমানের বিএনপি ছিল এন্টি-বাকশালী সকল মতের প্ল্যাটফর্ম। বাম, ডান, মুসলিম জাতীয়তাবাদী, সেন্ট্রিস্ট সবাই সেখানে জায়গা পেয়েছিল। আওয়ামী বাকশাল ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ রুখতে এই প্ল্যাটফর্ম ছিল অপরিহার্য।

আজ যদি বিএনপি আওয়ামী চেতনা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ঘোড়ায় চেপে, দিল্লির সহিসদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় পৌঁছাতে চায় তাহলে আমাদের আবার দরকার জিয়ার বিএনপির মতো একটি প্ল্যাটফর্ম। এমন একটি রাজনৈতিক জমিন, যা বাংলার মানুষের বিশ্বাস, মর্যাদা এবং ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবে রূপান্তরিত বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার কাছাকাছি থাকবে।

আমরা নারীরা স্পষ্ট করে বলছি ,অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে যারা পশ্চিমের আজ্ঞাবহ হতে চায়, জনগণ তাদের জবাব দেবে।জুলাই বিপ্লবের কাফেলা সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আজাদীর পথে এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নারীদের সমর্থন ও ভালোবাসা পশ্চিমা দালালদের জন্য নয়। এই সমর্থন আজাদীর কাফেলার জন্য কারণ এই বিপ্লবের প্রাণ আমরা নিজেরাই। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!