যেভাবে মেয়েদের জীবনকে বিধ্বস্ত করছে প্রতিশোধমূলক পর্ন
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২১, ০৪:৩৫ PM , আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২১, ০৪:৩৫ PM
‘আমি চেয়েছিলাম সবার প্রিয় হতে, নিজেকে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফল হয়েছিল একেবারে উল্টো।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্রিটেনের রিয়ালিটি টিভি তারকা জারা ম্যাকডারমট। তার জীবনের একটা কঠিন ও অন্ধকার সময়ের কথা বলেছেন বিবিসিকে।
যখন তার বয়স ১৪, তখন স্কুলের একটি ছেলের পীড়াপীড়িতে জারা তাকে তার গোপন অঙ্গের কিছু ছবি পাঠাতে রাজি হয়। স্কুল জীবনটা জারার জন্য মোটেও আনন্দের ছিল না। অন্যরা তাকে হেয় করত, সবসময় তার ওপর চড়াও হত। সে খুব নিঃসঙ্গ ছিল। তাই তার মনে হয়েছিল ওই ছেলেটি যদি তাকে পছন্দ করে, তাহলে স্কুলের সহপাঠীদের কাছে তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সহপাঠীরা তাকে অন্য চোখে দেখবে। কিন্তু ছেলেটি তার ওই অন্তরঙ্গ ছবিগুলো সারা স্কুলে ছড়িয়ে দিল। এবং অবস্থার উন্নতি তো হলই না, বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হল।
তিনি বলেন, আমি কোনো রকম যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতে পারছিলাম না কেন আমি সেটা করলাম। আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় তখন। আমি তখন নিজেকে কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক মনে করতে শুরু করেছি। নিজেকে জানছি। খুবই অন্ধকার একটা সময় সেটা। আমাকে নিজেকে পুরো গুটিয়ে নিয়েছিলাম। ছবিগুলো সবার কাছে তখন ঘুরছে। মনে আছে আমি ভালো করে খেতাম না, ঘুমাতাম না। সবসময় বিপর্যস্ত আর অবসন্ন থাকতাম। একসময় আত্মহত্যা করার কথাও ভাবলাম। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল। মনে হচ্ছিল ছবিগুলো দেখার পর সবাই আমাকে নিয়ে আরও ঠাট্টা মস্করা করবে, আমাকে হেনস্থা করবে, টিটকিরি দেবে। এই ভাবনা থেকে আমি বের হতে পারতাম না। আজও ওই ছবিগুলোর স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
কিন্তু এ ধরনের অন্তরঙ্গ ছবি একজনকে পুরো আস্থায় নিয়ে দেবার ঘটনা জারার জীবনে আবার ঘটে ২০১৮ সালে যখন তার বয়স ২১ এবং তিনি ‘লাভ আইল্যান্ড’ শো-তে অংশ নেন। তার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো বেশ কিছু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করা হয়। তবে ওই টিভি শো-র কারণে তাদের যেহেতু তখন জনবিচ্ছিন্ন একটা আলাদা বাসায় রাখা হয়েছিল এবং যেখানে ফোন রাখার অনুমতি ছিল না, তাই জারা বিষয়টা তখন জানতেই পারেননি। শো শেষ হবার পর অনুষ্ঠানের প্রচার বিষয়ক একজন কর্মকর্তা তার হোটেলে গিয়ে তাকে খবরটা দেন। তিনি জানান, তার ছবি ক্ষিপ্রতার সাথে শেয়ার হচ্ছে এবং ততক্ষণে সংবাদমাধ্যমেও খবরটা ছাপা হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমার মানসিক অবস্থা আমি বলে বোঝাতে পারব না।’ অনুষ্ঠানে কান্নায় ভেঙে পড়ে জারা বলেন, আমার মনে হয়েছিল আমার বাবা-মার কথা, তাদের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা। তারা কি আমাকে আর আগের মত নিতে পারবেন? লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। আমি মরতে চেয়েছিলাম।
জারা অভিযোগ করেন লাভ আইল্যান্ড টিভি শো-তে অংশ নেবার আগে একজন পুরুষের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল, সেই এই ছবিগুলো শেয়ার করেছে। জারার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ওই পুরুষকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে যখন জানতে চান কেন তিনি একাজ করেছেন, ওই পুরুষ তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন।
ভুক্তভোগীদের ওপরই দোষারোপ
জারা ম্যাকডারমট: রিভেঞ্জ পর্ন শিরোনামে বিবিসি থ্রি চ্যানেল, একটি তথ্যচিত্র প্রচার করেছে যাতে রিভেঞ্জ পর্ন বা প্রতিশোধমূলক পর্নছবির প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। রিভেঞ্জ পর্ন বলতে বোঝায়, যেখানে বিনা সম্মতিতে কারো অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বা কোনো নারীর দেওয়া নগ্ন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় সবার দেখার জন্য- যার বেশিরভাগই ছড়ানো হয় অনলাইনে। আর এসবের উদ্দেশ্য থাকে ভুক্তভোগীদের চরম দুর্দশার মধ্যে ফেলা, বিব্রত এবং হেনস্থা করা।
জারার একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি একবার নয়, দু দুবার এভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ায় তিনি স্বভাবতই ক্রুদ্ধ। যারা এসব ছবি ছড়িয়েছে তার রাগ শুধু তাদের ওপরেই নয়, কিন্তু এরপরে তিনি যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তাতেও তিনি ক্ষুব্ধ।
তাকে সামাজিক মাধ্যমে, অনলাইনে ব্যাপক ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। এসবের জন্য দোষারোপ করা হয়েছে তাকেই। তিনি বলেছেন তিনি যে ছবিগুলো কাউকে পাঠিয়েছেন, লোকে শুধু সেটা নিয়েই কথা বলেছে। কিন্তু তার সম্মতি না নিয়ে যে আরেকজন এসব ছবি শেয়ার করেছে, সেই মানসিকতা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। সমস্যাটা হলো লোকে অনলাইনে একটাই প্রশ্ন করে, ‘সে এরকম ছবি কেন তুলতে গেল? এমন মন্তব্যও এসেছে যে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করার জন্য সে এরকম ছবি কেন তুলেছে বুঝতে পারছি না!
জারা বলেছেন, আমাকে যে কতটা অসম্মান করা হয়েছে, আমার আস্থার জায়গাটা যে আরেকজন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, এখানে একজন যে আইন লঙ্ঘন করেছে, সেটাকে কেউ সামনে আনেনি।
‘ইনস্টাগ্রামে আমার নগ্ন ছবি’
জারা একা নন। রিভেঞ্জ পর্নের ঘটনা বিশেষ করে ঘটছে বহু কিশোরী মেয়ের জীবনে, এবং যাদের বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে তাদের ক্ষেত্রে। ব্রিটেনে যৌন নির্যাতন নিয়ে কাজ করে সেফলাইন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এই তথ্য দিয়েছে। শ্লো নাম এক নারী জানিয়েছেন, তিনি যখন কিশোরী তখন একদিন কাজ থেকে বাসে করে বাসায় ফেরার সময় তিনি স্ন্যাপচ্যাটে একটি মেসেজ পান। যে অ্যাকাউন্ট থেকে মেসেজ এসেছিল তাকে তিনি চিনতেন না।
মেসেজ খুলে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। সেখানে পোস্ট করা তার একটি নগ্ন ছবি, সেই সঙ্গে হুমকি দেয়া বার্তা যে ওই দিনই রাত আটটার মধ্যে সে যদি তার নগ্নদেহের আরও ছবি শেয়ার না করে, তাহলে অন্য নগ্ন ছবিগুলো ‘সব জায়গায় পোস্ট করা হবে’।
ওই অ্যাকাউন্ট থেকে এরপর তার আরও নগ্ন ছবি পাঠানো হতে থাকে, যেগুলো সে শুধুমাত্র তার প্রাক্তন প্রেমিককে দিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার পর তার এক বান্ধবী তাকে ফোন করে, ‘শ্লো- তোমার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তুমি তোমার কিসব ছবি পোস্ট করছ?’ শ্লো বলেন, তার প্রাক্তন প্রেমিক তাকে মানসিকভাবে প্রচুর নির্যাতন করত। তার কাছে সম্ভবত শ্লো-র অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ছিল, যা ব্যবহার করে সে শ্লোর নগ্ন ছবিগুলো শ্লো-র ইনস্টাগ্রাম আকাউন্টে তুলেছে।
তিনি বলেন, আমার প্রথম দুশ্চিন্তা ছিল আমার পরিবারের লোকজন যদি এসব দেখে? আমার বন্ধুরা যদি দেখে! এটা তো শেয়ার করা হবে, আমার কর্মস্থলের লোকেরা দেখবে, তারপর আমাকে চাকরি খোয়াতে হবে। শ্লো বলেন, সে রাতে বাসায় ফিরে আমি একা বসে ভাবছিলাম কী করব! বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না! জীবনে কাউকে কি আর কোনো দিন বিশ্বাস করতে পারব?
তিনি বলেছেন, তার জীবনের একটা কালো মুহূর্ত ছিল সেটা। মনে হয়েছিল তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ আমি বের হইনি, কাউকে মুখ দেখাইনি। এরপর এক বান্ধবী জোর করে আমাকে এক সন্ধ্যেয় বাইরে নিয়ে গেল। আমরা পানশালায় গিয়েছিলাম। সেখানে একদল অপরিচিত ছেলে এসে ‘আমার স্তন’ নিয়ে মস্করা শুরু করল, বলল তারা হোয়াটসঅ্যাপে আমার নগ্ন ছবি দেখেছে। আমি কখনও এমন ছোট হইনি, এমন ঘৃণ্য পরিস্থিতির মুখে পড়িনি।
শ্লো চান এ ধরনের প্রতিশোধমূলক পর্ন ছবি ছড়ানো ভুক্তভোগীর জীবন কিভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে তা মানুষকে জানাতে।
নগ্ন ছবি শেয়ার অপরাধ
কারো ব্যক্তিগত মুহূর্তের বা নগ্ন শরীরের ছবি বা ভিডিও আরেকজনের কাছে বিনা সম্মতিতে পাঠানো ব্রিটেনে অপরাধ। কিন্তু সেটা তখনই অপরাধ বলে গণ্য হবে যদি প্রমাণ করা যায় যে কাউকে বিব্রত বা বিপর্যস্ত করতে সেই ছবি অন্য কেউ পাঠিয়েছে। এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০১৫ সালে এবং এর জন্য দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
‘কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ খুবই কঠিন,’ ব্যাখ্যা করেছেন নট ইওর পর্ন নামে একটি আন্দোলনকারী সংস্থার কেট আইজ্যাক। তারা এই আইনে বদল চাইছে। তারা বলছে, বর্তমান আইনে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে অসৎ উদ্দেশ্যে এই ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে- আদালতে এর স্বপক্ষে প্রমাণ হাজির করা খুবই কঠিন।
‘জারার ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল, অর্থাৎ তার নগ্ন ছবিগুলো যেভাবে স্কুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তারা যদি এ ধরনের আচরণের শিকার হয়, তাহলে ওই ছবি তোলার জন্য তাকে দোষারোপ করা হবে না। তাদের জানতে হবে যে বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ বা পুলিশকে জানালে তারা বিপদে পড়বে না, বলেন কেট আইজ্যাক।
উদ্বেগ বাড়ছে
প্রতিহিংসা নিতে বা সম্মানহানির লক্ষ্যে যখন কারো নগ্ন দেহের বা একান্ত ব্যক্তিগত ছবি সকলের দেখার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় যা রিভেঞ্জ পর্ন বা প্রতিশোধমূলক পর্ন বলে পরিচিত, তা একজন ভুক্তভোগীর জীবন সবদিক থেকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। যারা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন তারা বলেছেন এর লজ্জা, গ্লানি তাদের জীবন কীভাবে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। একজনকে অতি আপনার এই বিশ্বাস থেকে যেসব ছবি সে তাকে দিয়েছে, সে যখন সেসব ছবি প্রতিহিংসা নিতে সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়, তখন মনে হয় পুরো পৃথিবী তার জন্য ভেঙে পড়েছে।
তারা বলেছে মানুষের চোখে চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলে। আশপাশের প্রত্যেকটা মানুষকে দেখলে মনে হয় সেও বুঝি তার নগ্ন শরীরের ছবিগুলো দেখেছে। এই সমস্যা বড় ধরনের মানসিক বিপর্যয় তৈরি করছে, এমনকি অনেককে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে বলে বলছে এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো।
রিভেঞ্জ পর্ন হেল্প লাইন নামে ব্রিটেনে কাজ করছে যে সহায়তাদানকারী সংস্থা তার পরিচালক সোফি মর্টিমার বিবিসি থ্রি-র এই অনুষ্ঠানে বলেছেন এই সমস্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। জারা বা শ্লোর মতো অনেকেই কিশোরী বয়সে এ ধরনের ছবি তুলে প্রেমিক বা ছেলে বন্ধুদের হাতে তুলে দিয়েছে বলে আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়েও এসব ক্ষেত্রে কিশোরীরা আইনের সাহায্য নিতে এগিয়ে আসতে ভয় পায়।
ঘটনার শিকার হবার পর গ্লানি ও মানসিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি ব্যাপারটা জানাজানি হবার ভয়ও তাদের থাকে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো বলছে বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে যেখানে এ ধরনের ছবি ও ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে দেবার সহজ প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, সেখানে শিশুদের বড় হয়ে ওঠার সময় এই ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলার ওপরেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।
সূত্র: বিবিসি