হার্ভার্ডের ৩৮৯তম জন্মদিন আজ, জেনে নিন বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০টি চমকপ্রদ তথ্য
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:২৭ PM
বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়; এটি জ্ঞান, সংস্কৃতি, নেতৃত্ব ও মানবতার বিকাশের কেন্দ্র। পৃথিবীতে বহু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধু শিক্ষা নয়, সভ্যতা ও চিন্তার ইতিহাসেও রেখেছে অনন্য ছাপ। এ তালিকার শীর্ষে নিঃসন্দেহে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকে এটিকে বলেন, আধুনিক জ্ঞানযুগের মস্তিষ্ক ও নৈতিক শক্তির প্রতীক।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কেমব্রিজ শহরে অবস্থিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর। আজ মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির ৩৮৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রায় চার শতাব্দী ধরে হার্ভার্ড হয়ে আছে বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির অন্যতম উৎস।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের পিউরিটান ধর্মযাজকদের উদ্যোগে। তারা বিশ্বাস করতেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে শিক্ষাই হতে হবে প্রধান শক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় জন হার্ভার্ডের নামে, যিনি ছিলেন এক তরুণ পাদ্রি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দাতা। ১৬৩৮ সালে মৃত্যুর আগে জন হার্ভার্ড তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ও সম্পত্তি নতুন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দান করেন। প্রথমদিকে এটি ছিল ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পরে ধীরে ধীরে রূপ নেয় আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও মানববিদ্যার শ্রেষ্ঠ আসরে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সারা বিশ্বে কৌতূহলের শেষ নেই যেন। এটি যেন জ্ঞানের রাজপ্রাসাদ, যেখানে ইতিহাস, গবেষণা, ঐতিহ্য ও উদ্ভাবন মিলেমিশে এক অনন্য সত্তা গড়ে তুলেছে। প্রায় চার শতাব্দী ধরে হার্ভার্ড মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক অভিযাত্রার এক প্রতীক। এখানেই জন্ম নিয়েছে অসংখ্য বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনীতিক ও চিন্তাবিদ। তাদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। শুধু শিক্ষা নয়, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানবকল্যাণের প্রতিটি অধ্যায়ে হার্ভার্ডের অবদান অনন্য। এ লেখায় কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জেনে নিন ১০টি চমকপ্রদ তথ্য।
১. বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
১৬৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রায় দেড় শতাব্দী আগে জন্ম হয় প্রতিষ্ঠানটির। তারপর ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ও সভ্যতার ভিত্তি গড়ে দেয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্বই যেন আলোকিত করেছে হার্ভার্ড। আমেরিকার প্রথম মুদ্রিত বই, প্রথম গ্রন্থাগার, এমনকি প্রথম বিজ্ঞান গবেষণাগারের জন্মও ঘটে হার্ভার্ড থেকেই। চার শতাব্দী পার করেও হার্ভার্ড এখনো জ্ঞান ও নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে টিকে আছে।
২. বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বিশ্ববিদ্যালয়
মানসম্পন্ন শিক্ষায় যেমন সেরা, তেমনই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৫ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির তহবিল বেড়েছে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার, মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। হার্ভার্ডের তহবিল বা Endowment Fund বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বাধিক। এ বিশাল তহবিলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বছরে শত শত গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করে, হাজারো শিক্ষার্থীকে পূর্ণ বৃত্তি দেয় এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করে। হার্ভার্ডের প্রতিটি অনুষদ (Law, Business, Medical, Kennedy School ইত্যাদি) নিজস্ব তহবিল থেকে নতুন উদ্ভাবনে অর্থ জোগায়। বিপুল অর্থ ও আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণা ও উদ্ভাবনে আত্মনির্ভর।
৩. বিশ্বের সবচেয়ে বড় একাডেমিক সংগ্রহ
হার্ভার্ডের লাইব্রেরি নেটওয়ার্ক বিশ্বের সবচেয়ে বড় একাডেমিক সংগ্রহগুলোর একটি। এখানে রয়েছে প্রায় ২ কোটি বই, লক্ষাধিক বিরল পাণ্ডুলিপি ও ঐতিহাসিক দলিল। সবচেয়ে বিখ্যাত লাইব্রেরি Widener Library, এটি টাইটানিক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র হ্যারি উইডেনারের স্মৃতিতে নির্মিত। এ গ্রন্থাগারে প্রাচীন ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞানপত্র পর্যন্ত রয়েছে। সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে তা যেন সোনার খনি।
৪. বৈচিত্র্যময় শিক্ষার্থী সমাজ
বর্তমানে হার্ভার্ডে পড়াশোনা করে ১৪০টিরও বেশি দেশের শিক্ষার্থী। প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়, যার বড় অংশই আন্তর্জাতিক। এ বৈচিত্র্য হার্ভার্ডকে শুধু একাডেমিকভাবে নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ করেছে। একই ক্লাসে আফ্রিকার এক গ্রাম থেকে আসা ছাত্র যেমন থাকে, তেমনি থাকে ইউরোপ বা এশিয়ার শহরের প্রতিভাবান শিক্ষার্থী। এ বৈচিত্র্যই হার্ভার্ডকে ‘বিশ্বের প্রতিচ্ছবি’ বানিয়েছে।
৫. ১৬০ জনের বেশি নোবেল বিজয়ীর সংযোগ
হার্ভার্ডের সঙ্গে যুক্ত ১৬০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ী। তাদের মধ্যে রয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান, অর্থনীতিবিদ আমর্ত্য সেন, রসায়নবিদ মার্টিন কারপ্লাস এবং সাহিত্যিক টি এস এলিয়টসহ বিশ্বখ্যাত সব ব্যাক্তিত্ব। শিক্ষক, গবেষক কিংবা প্রাক্তন শিক্ষার্থী—যে ভাবেই হোক, হার্ভার্ডের ছোঁয়া পাওয়া নোবেলজয়ীরা প্রমাণ করেছেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক অর্থে বিশ্ববিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি।
৬. বিশ্বজোড়া প্রভাব
হার্ভার্ড শুধু শিক্ষায় নয়, প্রভাবেও অনন্য। যুক্তরাষ্ট্রের আটজন প্রেসিডেন্ট, অসংখ্য প্রধানমন্ত্রী, কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
এছাড়া ব্যবসা ও প্রযুক্তিক্ষেত্রেও হার্ভার্ডের স্নাতকরা বিশ্বশক্তি তৈরি করেছেন। গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকসহ অগণিত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন হার্ভার্ডের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এ কারণেই অনেকেই বলেন, ‘হার্ভার্ড শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি ভবিষ্যৎ বিশ্বের নীতিনির্ধারক তৈরির কারখানা।’
৭. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্মস্থান
২০০৪ সালে হার্ভার্ডের এক ছাত্রাবাসে বসে জন্ম নেয় ফেসবুক। তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ ও তার সহপাঠীরা মিলে তৈরি করেছিলেন এক অনলাইন নেটওয়ার্ক, তখন এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল। পরে সেটিই পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আজ ফেসবুক শুধু এক প্রতিষ্ঠান নয়, মানব যোগাযোগের ইতিহাসেরই অংশ, যার সূচনা হয়েছিল হার্ভার্ডের এক ঘর থেকে।
৮. ল্যাটিন ভাষায় সমাবর্তন বক্তৃতা
১৬৪২ সালে প্রথম সমাবর্তন থেকে শুরু করে আজও হার্ভার্ডে প্রতি বছর একজন শিক্ষার্থী ল্যাটিন ভাষায় বক্তৃতা দেন। এ প্রথা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় জ্ঞানের শেকড় কত গভীরে প্রোথিত। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও এই অনুষ্ঠান হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের কাছে গর্বের বিষয়।
৯. কিংবদন্তি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ঐতিহ্য
হার্ভার্ডের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তালিকা যেন এক বিশ্বকোষ। রাজনীতিতে জন এফ কেনেডি, বারাক ওবামা, বান কি মুন; প্রযুক্তিতে বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ; সাহিত্য ও মানবাধিকার আন্দোলনে হেলেন কেলার, রুথ ব্যাডার গিন্সবার্গ; বিনোদনে নাটালি পোর্টম্যানসহ শিক্ষা, চিকিৎসা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় অগণিত সেরা মানুষ একসময় হেঁটেছেন হার্ভার্ডের সবুজ চত্বরে। তাদের জীবন ও কাজ আজও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে মনে করিয়ে দেয়, ‘এ ক্যাম্পাস থেকেই পৃথিবী বদলানো সম্ভব।’
১০. ‘Veritas’—সত্যের অনুসন্ধান
হার্ভার্ডের মূলমন্ত্র এককথায় গভীর ‘Veritas’, অর্থাৎ ‘সত্য’। এ একটি শব্দই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনকে প্রকাশ করে। জ্ঞান, যুক্তি ও মানবতার আলোয় সত্যের অনুসন্ধান।
হার্ভার্ড শেখায়, শিক্ষা মানে শুধু তথ্য জানা নয়; বরং মানুষের ভেতরের অন্ধকার দূর করে আলোকিত মানুষ হয়ে ওঠা। সত্য, ন্যায় ও মানবকল্যাণের পথে হাঁটাই হার্ভার্ডের চিরন্তন বার্তা।
সর্বোপরি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮৯ বছরের ইতিহাস শুধু এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়; এটি মানবসভ্যতার এক ধারাবাহিক জাগরণের গল্প। এখান থেকে উঠে এসেছেন রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও কবি-সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন পেশার অগণিত গুণীজন। তারা জ্ঞানের আলোয় বদলে দিয়েছেন পৃথিবীকে। আজ যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নতুন শতাব্দীর পথে পা রাখছে, তখনও তার চেতনা একই রকম দীপ্ত ‘Veritas’, অর্থ্যৎ, সত্যের অনুসন্ধানেই জ্ঞানের মহিমা।