পাকিস্তানি স্বামী-বাংলাদেশি স্ত্রী, ভুয়া পরিচয়ে ১০ বছর ধরে ভারতে

রশিদ সিদ্দিকি ও আয়েশা হানিফ
রশিদ সিদ্দিকি ও আয়েশা হানিফ  © সংগৃহীত

ভুয়া পরিচয়পত্র নিয়ে ভারতে বসবাস করার অভিযোগে বেঙ্গালুরু আর চেন্নাইয়ের পুলিশ আটজনকে গ্রেফতার করেছে। এই আট ব্যক্তি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাসিন্দা। তারা গত ১০ বছর ধরে প্রথমে দিল্লিতে, পরে বেঙ্গালুরুতে বাসা নিয়েছিলেন।

তারা যেসব ভুয়া পরিচয়পত্র বানিয়েছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে ভারতের পাসপোর্টও।

বেঙ্গালুরু পুলিশ যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে, তাদের মধ্যে আছেন এক পাকিস্তানি নাগরিক, যার স্ত্রী বাংলাদেশের এক নারী। এই নারীর মা-বাবাও তাদের সঙ্গেই ভারতে বসবাস করছিলেন। তারা যেসব ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করিয়েছিলেন, তাতে হিন্দু নাম ব্যবহার করা হয়েছিল।

এই খবর সামনে আসার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকেই বিস্মিত হলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা খুব অবাক হচ্ছেন না।

যেভাবে তাদের খোঁজ পেল পুলিশ
বেঙ্গালুরু পুলিশের কাছে তাদের ব্যাপারে প্রথম খবরটা আসে চেন্নাইয়ের ইমিগ্রেশন দফতর থেকে। অভিযুক্তরা যখন বাংলাদেশ থেকে ফিরছিলেন, তখন তাদের পাসপোর্ট দেখে চেন্নাইয়ের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। ওই অভিযুক্তরা বাংলাদেশে একটি ধর্মীয় জমায়েতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।

তারা যেখানে বাসা নিয়েছিলেন, তার সদর দরজার ওপরে হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক লাগানো ছিল। কিন্তু ঘরের ভেতরের ছবিটা ছিল অন্য রকম। সেখানে ‘মেহেদী ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল জশন-এ-ইউনুস’ এই শব্দাবলির উল্লেখ দেখা যায়।

এই সুফি সংগঠনটি আন্তর্ধর্মীয় সৌহার্দ বাড়ানোর জন্য কাজ করে বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন: ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ কাজ করে যেভাবে

৪৮ বছর বয়সী রশিদ আলি সিদ্দিকি পাকিস্তানের নাগরিক। তার সঙ্গে বাংলাদেশি এক নারীর বিয়ে হয়েছিল অনলাইনে। নিজের ধর্মবিশ্বাসের কারণে সিদ্দিকির পাকিস্তানে বাস করা সমস্যা হয়ে উঠেছিল বলে তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন। তারপরই তিনি বাংলাদেশে গিয়ে থাকতে শুরু করেন।

এরপর স্বামী-স্ত্রী এবং সিদ্দিকির শ্বশুর-শাশুড়ি চারজনই বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লি চলে যান। সেখানেই হিন্দু নাম, ভুয়া পাসপোর্ট ও ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র আধার কার্ড বানিয়ে নেন তারা, এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ।

রশিদ সিদ্দিকি ভারতে এসে নাম নেন শঙ্কর শর্মা। তার স্ত্রী আয়েশা হানিফ হয়ে যান আশা রাণী। হানিফের বাবা মুহম্মদ হানিফ নাম নেন রামবাবু শর্মা এবং তার স্ত্রী অর্থাৎ রশিদ সিদ্দিকির শাশুড়ির নাম রুবিনা থেকে হয়ে যায় রাণী শর্মা।

কর্ণাটক পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক এসটি রমেশ বিবিসিকে বলছিলেন, ‘পুলিশ এখন ১০ বছরের পুরনো ঘটনার তদন্তে নেমেছে কারণ হঠাৎ এ রকম একটা মামলা তাদের হাতে এসে হাজির হয়েছে।’

কেন এসেছিলেন ভারতে
এফআইআরে পুলিশ লিখেছে, ২৯ সেপ্টেম্বর তারা ভিলা কমপ্লেক্সে পৌঁছান। তাদের কাছে খবর ছিল যে চারজন বাংলাদেশি সেখানে থাকছেন। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

রশিদ সিদ্দিকি পুলিশকে জানান যে তারা দিল্লিতে থাকতেন, পরে ২০১৮ সালে বেঙ্গালুরু আসেন তারা। তাদের সবাইকে মেহেদী ফাউন্ডেশনের হয়ে প্রচারণার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

পরিবারের চারজনের পাসপোর্ট, আধার কার্ড, প্যান কার্ড এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সব তথ্য পুলিশকে দিয়েছেন। তিনি এ-ও জানিয়েছেন যে তার ও আয়েশার বিয়ে হয়েছিল ২০১১ সালে।

বাংলাদেশে বসবাস শুরু করলে সেখানেও কয়েকজন ধর্মীয় নেতা সমস্যা তৈরি করেন বলে অভিযোগ করেছেন রশিদ সিদ্দিকি। এরপর মেহেদী ফাউন্ডেশনের ভারতীয় শাখার সঙ্গে যুক্ত পারভেজের সঙ্গে দেখা হয় রশিদের।

আরও পড়ুন: ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে পাকিস্তান: শাহবাজ শরিফ

এই পারভেজই পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তারা ভারতে আশ্রয় নিতে পারেন। এফআইআর অনুযায়ী ২০১৪ সালে দালালদের অর্থ দিয়ে তারা ভারতে আসে।

কী জানিয়েছেন গ্রেফতার ব্যক্তিরা
রশিদ সিদ্দিকি পুলিশকে বলেছেন যে পারভেজই দিল্লিতে বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। ওই ঠিকানা দিয়েই তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্স ও আয়কর বিভাগের সচিত্র পরিচয়পত্র প্যান কার্ড বানিয়ে নেন।

সিদ্দিকি ও তার কয়েকজন আত্মীয় ওই পরিচয়পত্রগুলো তৈরির সময়েই হিন্দু নাম গ্রহণ করেন। তার এক আত্মীয় ইয়াসিন নাম নেন কার্তিক শর্মা আর জয়নাব নূরের নাম হয় নেহা শর্মা। অন্য আত্মীয়রাও নিজেদের নাম বদল করে নেন।

মেহেদী ফাউন্ডেশনের কাজে যোগ দিতে ২০১৮ সালে সিদ্দিকি নেপালে গিয়েছিলেন। সেখানে তার যোগাযোগ হয় ওয়াসিম এবং আলতাফ নামের দুই ব্যক্তির সঙ্গে। এই দুজন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা ছিলেন।

ওই আলাপের সূত্র ধরেই রশিদ সিদ্দিকি ও তার পরিবারের বেঙ্গালুরুতে আসা, এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ। সিদ্দিকি বেঙ্গালুরুর যে বাসায় থাকতেন, তার ভাড়া মেটাতেন আলতাফ নামে একজন। এরপর অন্য সব ভুয়া পরিচয়পত্রে বেঙ্গালুরুর ঠিকানাই ব্যবহার করেছেন সিদ্দিকি।

তিনি পুলিশকে এ-ও বলেছেন, ‘ভারতে আসার পরে করাচির লিয়াকতাবাদে নিজের আত্মীয়দের ফোনও করতাম আমি।’

অন্যদিকে পরিচয়পত্র নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় সিদ্দিকির যে আত্মীয়দের আটক করেছিল চেন্নাই পুলিশ, তাদের নাম ইয়াসিন, নূর, আলতাফ আহমেদ ও ফাতিমা।

এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, ‘বেঙ্গালুরু সিদ্দিকির নতুন ঠিকানা। সেখান থেকে তিনি দাভানগেরে, কালবুর্গি, বেলগাওয়ের মতো দূরবর্তী জায়গাগুলোয় গিয়ে মেহেদী ফাউন্ডেশনের জন্য কাজ চালাতেন।’

মেহেদী ফাউন্ডেশনের প্রধান দফতর লন্ডনে অবস্থিত।

আরও পড়ুন: জামায়াত যে কারণে ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট গড়ার চেষ্টা করছে

গোয়েন্দা ব্যর্থতা
কর্ণাটক পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত আইজি গোপাল হোসর বলেন, ‘এটা খুব একটা মুশকিলের কাজ না। সাধারণ মানুষ পুলিশকে দেখলেই ভয়ে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ আগে থেকে সব ঠিক করে আসে যে তাকে সীমান্ত পেরতে হবে, তবে সে পেরিয়ে আসতে পারবে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনেক ফাঁকফোকর আছে। তাই এটা অবিশ্বাস্য কিছু না।’

তার কথায়, এই সমস্যার শুরু সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো থেকে। কোনও ব্যক্তি-বিশেষের ওপরে নজর রাখা খুব একটা কঠিন নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে গোয়েন্দাদের যেভাবে কাজ করা উচিত, সেভাবে তারা নিজেদের কাজটা ঠিক মতো করছেন না।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিচালক এস টি রমেশ বলছিলেন, ‘পাসপোর্ট আর অন্যান্য পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করা একটা একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠেছে। অনেকে রোজগারের তাগিদে আসছে, কেউ বা আবার অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু কারণে মানুষ চলে আসেন এ দেশে। বেশির ভাগই কাজের সন্ধানে আসেন। এটা তো শুধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, পুলিশেরও দায়িত্ব আছে এখানে।’

রমেশ আরও বলছিলেন, ‘এই ব্যাপারে আমাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে। থানা, জেলা, রাজ্য এমন জাতীয় স্তরে পুলিশের উচিত আরও বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য যোগাড় করা। এটা তাদের ব্যর্থতা। এখন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা


সর্বশেষ সংবাদ