‘আমাদেরও রাগ হয় অভিমান হয়, ক্লান্তি আসে ক্ষুধা লাগে’

ডাক্তার
ডাক্তার   © প্রতীকি ছবি

'আমাদের দেশের ডাক্তারদের দোষের অন্ত নাই। ভাগ্যিস এখন নাইট করতে হয় না। তবে রাত-বিরাতে এমার্জেন্সি সিজার করতে বের হলে বাড়ীর লোক তো বটেই, পাড়া-প্রতিবেশী কি ভাববে, সেটাই ভাবছি। ঐ যে দু’দিন আগেই না বললাম, যত দোষ নন্দ ঘোষ! ডাক্তাররা চামার, ডাক্তাররা কসাই, ডাক্তারদের ব্যবহার খারাপ….ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কি! 
কিন্তু ওদিকে রোগীরা যে কি করে, কি কারণে দিনে দিনে ডাক্তাররা অসহিষ্ণু আর খিটখিটে হয়ে ওঠে তা আজীবনই রয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। 
আজ এক রোগীর গল্প বলি। রোগীরা যে কিভাবে যন্ত্রণা দেয়! সে এ পর্যন্ত তিনবার ভর্তি হয়েছে আমাদের হাসপাতালে। 
প্রথমবার আসলো। তার ডেলিভেরী ডেট পার হয়ে গেছে। ব্যাথা নাই। পরীক্ষা করে দেখলাম, তার জরায়ুর মুখ খোলেনি। বললাম, থাকো। আমরা একটু ট্রায়াল দিই। না হলে পরের দিন সিজার করবো। সিজারের কথা শুনে সে গেল পালায়ে । এভাবে একবার না, দু’বার না, তিন তিনবার একই কাজ করলো সে। 
আজ সব রোগী দেখা শেষ করে যখন ওটি শুরু করব তখন সে আসলো। ইতোমধ্যে তার ডেট পার হয়েছে এক সপ্তাহেরও বেশী প্রায়। দেখলাম তাকে। ফাইন্ডিংস সুবিধার না। তবু ট্রায়ালে দিলাম। বললাম, আমি সিজার শেষ করতে করতে তোমার প্রগ্রেস না হলে কিন্তু সিজার হবে। আজ আর তোমাকে ফেলে যাব না। 
সব ওটি শেষ করার পরেও আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কোন প্রগ্রেস নাই। শেষে তাকে ওটিতে নেয়া হল।সে এমনভাবে কাঁদতে কাঁদতে ঢুকলো, যেন শ্বশুরবাড়ীর উদ্দেশ্যে বিদায় নিচ্ছে। দেখি, তার মা কাপড়-চোপড় নিয়ে তার পিছে পিছে ঢুকছে। 
যা হোক, আমরা অনেক হাসাহাসি করে তাকে মোটামুটি স্বাভাবিক করে নিয়ে তার ওটি শুরু করলাম। তার বাচ্চা বের করে ছবিও তুলে রাখলাম। 
-থাকুক স্মৃতি। এটা দেখলে মনে পড়বে, ওর মা কত জ্বালায়েছিল আমাদের! 
সে আবার ফুট করে উত্তর দিল,
-ম্যাডাম, আমাকে কিন্তু ছবিটা দিয়েন। 
ওর ওটি শেষ করে অন্য আরেকটা শুরু করেছি। ওটি শেষে তার শারীরিক পরীক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চলছে। ওমা! দেখি সবাই এটাসেটা বলছে, সে উত্তর দেয় না। আমাদের এনেসথেসিয়ার কনসালটেন্ট ডা.রিফাত তাকে নানান প্রশ্ন করছে, সে কথা বলেনা । সে নাকি কথা বলতে পারছে না। ইশারা করে। ওটি ইনচার্জ নাসিমাকে কি যেন আবার বলতে চায়। নাসিমা একটা কলম ধরায়ে তার হাতটা এগিয়ে দিল। সে লিখেছে, 
-আজান দেয়া হয়েছে? সবাইকে খেঁজুর খাওয়ানো হয়েছে?
ফাজিল বলে কি! আমরা পড়েছি তার কন্ঠস্বর নিয়ে বিপদে, আর সে আছে খেঁজুর নিয়ে। 
-এফাসিয়া কেন হল? কি ব্যাপার? 
রিফাত বলল, 
-হতে পারে এমন স্পাইনালে। কিন্তু আমি তো ডোজ খুবই কম দিয়েছি ম্যাডাম। এমনকি ওর প্রেসারও ফল করেনি একটুও।
শেষ সিজারটা ছিল এ মাসের পঞ্চাশতম এবং সর্বশেষ সিজার। ঐটার ছবি তুলতে গিয়েই মনে পড়ল, আরে ঐ রোগী তো বাচ্চা বের হওয়ার পরেও কথা বলেছে। আমার কাছে ছবি চেয়েছে। 
রিফাতকে বলতেই সে আবারও গেল পাজীটাকে দেখতে। এমনিতেই বেচারা ওটি আর পোস্টঅপ করতে করতে হয়রান। তার উপর এই রোগীর আচমকা কন্ঠরোধ তাকে নাজেহাল করে রেখেছে। 
এইবার গিয়ে সে দেখে রোগীর নাক থেকে অক্সিজেনের ক্যানুলা খুলে গেছে। ও ইশারা করছে ওটা লাগিয়ে দেয়ার জন্য। ওটা লাগানোর সময় একটু ব্যাথা পেতেই সে কথা বলে উঠেছে,
-এটা সরান। ব্যাথা লাগে। 
ওরে ফাজিল! এই ছিল তোর মনে? এখন বলেন,হাসবো না কাঁদবো এদের নিয়ে। শেষ বিকেলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় কি পেরেশানিটাই না গেল এই দুষ্টটাকে নিয়ে! 
যা হোক, সব ভাল তার, শেষ ভাল যার। ওরা মা-ছেলে ভাল আছে, আমরা এতেই খুশী। আলহামদুলিল্লাহ্। 
পরিশেষে এটাই বলি, শুধু নিজেদের কথা চিন্তা না করে সবাই আমাদেরও একটু মানুষ ভাবুন। আমরা অসুরও নই, দেবতাও নই। আমাদের সবরেরও একটা সীমা আছে। আমাদেরও রাগ হয়, অভিমান হয়। আমাদেরও ক্লান্তি আসে, ক্ষুধা লাগে। বন্ধ দরজার ওপারে আমাদেরও মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। আর দশজনের মতো, দিনশেষে আমরাও তো আসলে রক্তমাংসের মানুষ বই অন্য কিছু নই!' 

লেখক: ডা: ফাহমিদা নীলা (গোবিন্দগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) 


সর্বশেষ সংবাদ