একজন ফেরেশতাকেও ঢাবির ভিসি বানালে স্বৈরাচারী হয়ে যাবে
- ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
- প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ০৪:৩০ PM , আপডেট: ০৭ জুন ২০২১, ০৭:৫৪ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের বয়স একশত বছর হতে যাচ্ছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এইটা কোন বয়সই না। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১১৬২! আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো মরোক্কোর University of Al Quaraouiyine! আশ্চর্যের বিষয় হলো এটির স্রষ্টা একজন মুসলিম নারী যার নাম ফাতিমা আল-ফিহরী (Fatima al-Fihri)। দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টিও মুসলিম দেশে। তার নাম মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৯৫১ বছর। সেই সময়টা ছিল মুসলমানদের স্বর্ণালী দিন। জ্ঞান বিজ্ঞানে তারা ইউরোপ আমেরিকা থেকে এগিয়ে ছিলেন। কি বোঝা গেল? কি বোঝা গেল? এতে বোঝা গেল মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে একটি সভ্যতা গোড়াপত্তন হয়।
মুসলমানরা যেদিন থেকে জ্ঞান বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করেছে সেদিন থেকেই মুসলমানদের দুর্গতি শুরু। মুসলমান সভ্যতা সম্মন্ধে জানতে হলে ইরাকি অরিজিন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জিম আল খালালির ল্যাঙ্গুয়েজ অফ সাইন্স ডকুমেন্টারীটি দেখুন (কমেন্ট থ্রেডে পাবেন)।
তৃতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইতালির University of Bologna! এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স হলো ৯৩৩ বছর। এর মাধ্যমেই শুরু হয় ইউরোপের রেনাইসেন্স (renaissance)। এর ধারাবাহিকতায় চতুর্থ প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পঞ্চম প্রাচীনতম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় স্পেনের University of Salamanca, ষষ্ঠ প্রাচীনতম ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস এবং সপ্তম প্রাচীনতম হলো ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যাদের বয়স যথাক্রমে ৯২৫, ৮৮৭, ৮৬১ এবং ৮১২ বছর।
১৬৩৬ সালে আমেরিকায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এর মাধ্যমেই জ্ঞানের সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি শিফট এবং তার সাথে আবার প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটে। এর মাধ্যমে আমেরিকা হয়ে উঠে সুপারপাওয়ার। এইবার আবার প্যারাডাইম শিফট হওয়ার লক্ষণ সুস্পষ্ট। চীন এখন সুপারপাওয়ার হচ্ছে কারণ তাদের টেসিংহুয়া ও পীকিং বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব রেঙ্কিং-এ হু হু করে উপরে উঠছে। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই এশিয়ার সেরা।
সেই চীনের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় Tsinghua University এবং দ্বিতীয় সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হলো পীকিং বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমটির বাজেট বরাদ্দ হলো প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা আর দ্বিতীয়টির বাজেট হলো প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বাজেট বরাদ্দের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। আবার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একটি দেশের মানুষের মানের সম্পর্ক আছে। ভালো মানুষই পারে একটি দেশকে উন্নত করতে। ভবন বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার আগে না।
আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন একটি সভ্য দেশ কখন অসভ্য হয়ে যায় আর অসভ্য দেশ কখন সভ্য হয়ে যায়। সভ্য হওয়ার সাথে ক্ষমতা সরাসরি সম্পর্কিত। শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হলে দেশ একদিকে যেমন উন্নত হয়ে একই সাথে ক্ষমতাবানও হয়। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সরকারেরা এই বিষয়টাই বুঝে না। হয়তবা বুঝে ঠিকই কিন্ত চায় না। চায়না কারণ হলো এই দেশের ক্ষমতাবানরা এই দেশের উন্নয়নের ভোক্তা না। তাদের ছেলেমেয়েরা এই দেশের সরকারী স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ভোক্তা না। আবার শিক্ষায় বিনিয়োগের সুফল আসে দীর্ঘমেয়াদে। ফলে তারা এমন কোন খাতে বরাদ্দ দিতে চায় না যার ভোক্তা তারা না এবং যার সুফল তারা হয়ত পাবে না।
এতক্ষণের আলোচনায় নিশ্চই বুঝতে পারছেন দেশকে উন্নত এবং বিশ্বে সম্মানিত আসনে দেখতে চাইলে আমাদের শুরু করতে হবে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশ্বমানের গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ার মাধ্যমে। এর কোন বিকল্প নাই। আমাদের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই দেশের জন্মে এর অবদান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় সকল বড় বড় প্রাপ্তির পেছনে এর অবদান অনস্বীকার্য। সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো এর মান ক্রমেই নিচে নামছে। এতে কারো কোন দ্বিমত।
এই সমস্যাটিকে ম্যাট্রেসের নিচে লুকিয়ে রেখে এর পুরোনো ঐতিহ্য শুনিয়ে গোটা দেশের মানুষকে ঘুম পারিয়ে রেখেছে। আমাদের প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে এর মান ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশী আমেরিকান পদার্থবিদ আতাউল করিম দেখিয়েছেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের নিম্নগতির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের মানের নিম্নগতি সরাসরি সম্পর্কিত। উনি দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পর থেকে বিশেষ করে ১৯৪৫ এর পর থেকে ভিসিদের মান ক্রমেই খারাপ হয়েছে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই নিম্ন মানের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের নিম্নগতির প্রধান কারণ এর ভিসির ক্ষমতা। এত ক্ষমতাধর ভিসি পৃথিবীতে আর কোন দেশে পাবেন না। আমি এইটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নাম সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় জানেনা বললেই চলে। এমনকি শিক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে জানেনা। এর কারণ শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষকদের প্রমোশনে ভিসির কোন একটিভ ভূমিকা নেই। যেইটুকু আছে সেইটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির মত সেরিমোনিয়াল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্ষমতা ভিসির মধ্যে কেন্দ্রীভূত। এত ক্ষমতা থাকলে একজন ফেরেশতাকে ভিসি বানালে সেও স্বৈরাচারী হয়ে যাবে। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় যদি স্বৈরাচারী হয় সেই দেশটি কেন স্বৈরাচারী হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের উন্নতির জন্য প্রথম যেই কাজটি করতে হবে সেটি হলো ভিসির ক্ষমতা হ্রাস করা। একজনের কাছে এত ক্ষমতা থাকায় এই পদ পাওয়ার জন্য শিক্ষকরা অনেকটা মরিয়া। সরকারও দেখে এই এক ব্যক্তিকে কন্ট্রোলে রাখলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে কন্ট্রোলে রাখা যায়। আর এটাই হলো ছাত্র শিক্ষক রাজনীতির মূল কারন।
আমাদের ছাত্ররা কি আসলে ছাত্র রাজনীতি করে? যদি করত তাহলে এই ছাত্রদেরকে আবাসিক হলগুলোতে কি বস্তির মত থাকতে হতো? এই ছাত্রদের কি ক্যান্ডির মত এক টুকরা মাংস প্লেটের এক কোনায় রেখে সেটা দেখে দেখে ভাত খেতে হতো? ছাত্র রাজনীতি যদি থাকতো তাহলে ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্ররা টর্চারের শিকার হতে হতো? আমিতো কোন ছাত্র রাজনীতি দেখি না। আমিতো দেখি ছাত্ররা এখন সরকারি দলের প্রহরীর কাজ করতে গিয়ে তাদের অত্যন্ত মূল্যবান জীবন গণহারে নষ্ট করছে। এইবার বুঝুন আমাদের সরকারই বা কতটুকু দেশপ্রেমিক আর ছাত্ররাইবা কতটা দেশপ্রেমিক।
আর শিক্ষক রাজনীতি? বিশেষ করে বড় দুই দলের রাজনীতি আরো খারাপ। এইগুলোকে রাজনীতি বলা যায়? অধিকাংশ শিক্ষক রাজনীতি করে নিজেদের লাভের জন্য। নিজেরা সামান্য লাভবান হওয়ার জন্য ছাত্রদের ভবিষ্যত একদম নষ্ট করে দিচ্ছে। এরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে। আর দেশের জনগণ যারা এইসব দেখেও চুপ করে আছে তারা আরো বড় অপরাধ করছে।
কল্পনা করা যায় প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য বাজেট হলো ৮০০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন আর অন্যান্য essential খরচ শেষে দুর্নীতি করার তেমন টাকাই থাকে না। তাই ভিসিরা আসলে আর্থিক দুর্নীতি করতে পারেনা। তবে নিয়োগসহ অন্যান্য দুর্নীতির ফলে ক্ষতিটা আরো বেশি হতে পারে। এই বরাদ্দ দিয়ে যে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলছে এটাইতো অষ্টমাশ্চর্য।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়